মো. শরীফুর রহমান

  ১৯ জুন, ২০১৭

আর নয় জাকাতের নামে মানুষ হত্যা

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে জাকাত তৃতীয় স্থানে। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী জাকাত গরিবদের প্রদান করা হয়, যা একটি আর্থিক ফরজ ইবাদত। এটি হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত বান্দার সম্পদ বৃদ্ধি ও পবিত্র করার মাধ্যম এবং ধনী কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে প্রদত্ত গরিবের অধিকার। শরিয়তের বিধান অনুযায়ী নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে শতকরা ২.৫ টাকা হারে জাকাত দিতে হয়। আল্লাহ পবিত্র কোরআনের যেসব জায়গায় নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন সেখানেই জাকাতের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের ৮৮ জায়গায় জাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানেই বিষয়টি পরিষ্কার যে, জাকাত আদায়ের গুরুত্ব কী এবং কতটা।

কিন্তু আমাদের দেশে জাকাত দেওয়ার নিয়ম এমন হয়ে যাচ্ছে যে, ঈদের সপ্তাহখানেক আগে থেকে ঢাকঢোল বাজিয়ে, মাইকিং করে জাকাত নেওয়ার জন্য জনসমাগম করানো হচ্ছে! আমাদের সমাজের কিছু কিছু মানুষ জাকাতের উদ্দেশ্য না বুঝে এ রকম একটি আর্থিক ইবাদতকে তামাশায় পরিণত করছে—যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি অত্যন্ত পরিতাপের। এসব ব্যক্তি কোনো হিসাব-নিকাশ না করেই কিছু লুঙ্গি-শাড়ি কিনে মানুষের মাঝে অব্যবস্থাপনায় বিতরণ করেই মহান হওয়ার অপচেষ্টা করছেন। মনে হয় সমাজে নিজের মোড়লীপনা দেখাতে চাইলে এ রকম লোক ডেকে শাড়ি-লুঙ্গি দিলেই পরের দিন নিজেকে ওই সমাজে মোড়ল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়! আরেকটু স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলা যায়, সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাকাত আদায়কে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে জাকাত দেওয়ার মধ্যে কোনো তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না। বরং এভাবে মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তির দিকে আরো উৎসাহিত করা হচ্ছে।

অথচ জাকাত আদায়ের উদ্দেশ্যই হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ। হজরত ওমরের (রা.) যুগে প্রথমবার যারা জাকাত গ্রহণ করেছে পরের বছর তারা জাকাত দিয়েছে আর এভাবে যদি জাকাত আদায় নিশ্চিত করা যায়, তবে কোনো ধরনের ক্ষুদ্রঋণ ছাড়া সমাজ থেকে চিরতরে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে সম্পদশালী লোকেরা প্রতিবছর যেভাবে জাকাত দেওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছেন তাতে কি কারো দরিদ্রতা দূরীভূত হয়েছে বলে কেউ বলতে পারবে? নাকি এ প্রবণতার মাধ্যমে আমরা সমাজকে আরো বেশি দরিদ্রতার দিকে ঠেলে দিলাম? এসব হীন মানসিকতার লোকদের অসুস্থ চিন্তা-চেতনার জন্যই মার্কেটগুলোতে জাকাতের কাপড় পাওয়া যায় বলে সাইনবোর্ড লাগানো থাকে আর জাকাতের কাপড়, লুঙ্গি শাড়ি মানেই হলো একেবারে নিম্নমান ও একেবারে সস্তামানের কাপড়। কিন্তু এভাবে জাকাতের টাকা দিয়ে শাড়ি-লুঙ্গি কিনে তা বিলিয়ে দেওয়ার শিক্ষা কোথায় পেল এ সমাজ? সমাজের উচ্চ বিত্তের কিছু মানুষ কোথা থেকে জানল, কিছু নিম্নমানের শাড়ি-লুঙ্গি বিলিয়ে দিলেই জাকাত আদায় হয়ে যায়?

জাকাত আদায়ের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো—জাকাতের সব টাকা একত্রিত করে যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য তাদের থেকে সর্বাধিক হকদারদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে নির্বাচন করে পুনর্বাসন করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে নিজেদের চলার ব্যবস্থা করতে পারে এবং পরবর্তীতে আর যেন জাকাত গ্রহণ করতে না হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় কয়েকজন খাটি আলেমের সমন্বয়ে একটি করে কমিটি গঠন করে ইসলামিক পন্থা অনুসরণ করে সর্বাধিক হকদারকে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। এটিই ছিল হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শেখানো পন্থা।

কিন্তু সমাজের কিছু লোক মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশিত পথে না গিয়ে সমাজকে করছে কলুষিত আর ইসলাম ধর্মকে করছে বিতর্কিত সর্বোপরি দেশকে মধ্যম আয়ের যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। এসব কাজের মধ্য দিয়ে ইসলামকে আজ বিশ্বে বিতর্কিত করা হচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে ইসলামের জাকাত ব্যবস্থাকে। এরা সমাজের, দেশের, মানুষের, সভ্যতার সর্বোপরি ধর্মেরও শত্রু। যাদের শত্রুতার দরুন পদদলিত হয়ে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে অসংখ্য নারী-নর। প্রতিবছর এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই সবাই সহমর্মিতা জানিয়ে কিংবা কয়েক দিন এ বিষয়ে মুখভারী করলেই মনে হয় সবার দায়িত্ব শেষ। পরবর্তীতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটার কোনো বাস্তব ও কার্যকরী উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। কেননা, যদি এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তবে প্রতিবছর একই ঘটনা বারবার ঘটত বলে মনে হয় না। অথচ প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৫ সালে জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে ময়মনসিংহে ২৭ জন নারী-শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু ও কয়েকজনের আহত হওয়ায় পুরো দেশ তখন শোকাহত ছিল। শুধু ২০১৫ সালে ময়মনসিংহেই নয়, বরং ১৯৮০ সালে ঢাকার জুরাইনে ১৩ জন, ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জাকাতের টাকা আনতে গিয়ে ৩ জন, ১৯৮৭ সালের ২৩ মে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একই উদ্দেশ্যে গিয়ে মারা যায় ৪ জন, ১৯৮৯ সালের ৫ মে চাঁদপুরে ১৪ জন, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রামের আবুল ফ্যাক্টরিতে জাকাতের টাকা আনতে গিয়ে মারা যায় ৩৫ জন, ২০১৪ সালে মানিকগঞ্জ ও বরিশালে ৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। সর্বোপরি, গত ৩৫ বছরে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি আনতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে ২৬১ জনকে।

উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আমাদের আলেম সমাজের এক্ষেত্রে কিছুটা গাফিলতি আছে। আলেম সমাজ অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই ফতোয়া জারি করতে পারে, কিন্তু এভাবে জাকাত দেওয়ার বিরুদ্ধে তাদের কোনো ফতোয়া নেই কেন? কেন এসব লোক দেখানো ও মানুষ মারার ফন্দিযুক্ত জাকাত আদায়কারীর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ মিছিল নেই? কেন এসব লোকদের সামাজিকভাবে বয়কট করার ঘোষণা আলেম সমাজ দেয় না? নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হকদারের ওপর সঠিকভাবে বণ্টন না করে মানুষ হত্যার পরিণতি সম্পর্কে আলেম সমাজ কোনো বিবৃতি কিংবা প্রতিবাদ করে না কেন? আলেম সমাজ কেন এই বলে বিবৃতি দেয় না যে, জাকাত কেবল রমজান মাসেই নয় পুরো বছরই দেওয়া যায়। অন্যদিকে সরকারের খেয়ালিপনায় এ ধরনের ঘটনা বারংবার ঘটছে। এ পর্ষন্ত এ ধরনের ঘটনার জন্য কিংবা মানুষ হত্যার দায়ে কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে প্রতিবছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে, যা কোনো সভ্য সমাজের কাম্য হতে পারে না।

আমার মতে, সরকারের সক্রিয়তার অভাব, প্রচলিত সমাজ কাঠামো, জাকাত বোর্ডের নিষ্ক্রিয়তা, ধর্ম সম্পর্কে মানুষের সঠিক জ্ঞানের অভাব, নিজেকে বড় করে দেখানোর প্রবণতা, আলেম সমাজ ও জাকাত প্রদানকারীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সমাজে সচেতনতার অভাব, ধনীদের দিকে লক্ষ্য রেখে বাজেট প্রণয়ন, সর্বোপরি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবেই বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সরকার যেভাবে প্রতিটি মানুষের নিকট ভ্যাট আর ইনকাম ট্যাক্স আদায় করছে ঠিক তেমনি জাকাত বোর্ডকে আরো শক্তিশালী করে প্রতিটি সম্পদশালী লোকের থেকে বাধ্যতামূলকভাবে জাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করে ইসলামের নির্দেশিত পন্থা অনুযায়ী তা বণ্টনের ব্যবস্থা করলে এইসব হীনমানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব।

পিডিএসও/হেলাল

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
জাকাত,দারিদ্র্য দূরীকরণ,কলাম
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist