তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

তেঁতুলিয়ায় বিষমুক্ত সবজি চাষ

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চাষ হচ্ছে কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহার মুক্ত নিরাপদ সবজি। প্রাকৃতিক উপায়ে নিরাপদ সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি বিভাগ। কৃষিবান্ধব সরকার রাসায়নিক মুক্ত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিয়ে কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ায় প্রাকৃতিকভাবে বিষমুক্ত শাক-সবজি আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন তারা। স্বাস্থ্যসম্মত এসব সবজিতে বাড়ছে চাহিদা ও ক্রেতাদের ভিড়।

চিকিৎসকরা বলছেন, কীটনাশক-রাসায়নিক সার ব্যবহারে উৎপাদিত সবজি খেয়ে মানবদেহে বিভিন্ন প্রকার রোগ-বালাই সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে পরিবেশ দূষণ, প্রকৃতির উপকারী পোকা মাকড় ধ্বংস হওয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কৃষকরা সাময়িক লাভবান হলেও সেটিতে মারাত্মকভাবে বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ‘কৃষক মাঠ স্কুল’ এর মাধ্যমে ৫ শতাধিক সবজি চাষিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। চলতি মৌসুমে দেড়শ কৃষক প্রায় ২শ বিঘা জমিতে বিষমুক্ত পরিবেশবান্ধব সবজি চাষ করছেন। প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন পরিবেশবান্ধব সবজি উৎপাদন হয়েছে। পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় তেতুলিয়ায় এই উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর।

কোন প্রকার রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপায়ে সবজি উৎপাদনের জন্য চাষিদের মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। কৃষকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কৃষক ক্লাব। ক্লাবের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে চাষিরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে বিষমুক্ত সবজি চাষ করছেন। এই সবজি বিক্রির জন্য তেঁতুলিয়া বাজারে গড়ে তোলা হয়েছে বিষমুক্ত সবজির দোকান।

উপজেলা কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার মোতালেব হোসেন জানান, ২০১৮ সাল থেকে এ উপজেলায় বিষমুক্ত সবজি চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রান্তিক কৃষকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কৃষক মাঠ স্কুল নামের এই প্রতিষ্ঠান কৃষকদের বাড়িতেই পরিচালনা করা হয়। নির্দিষ্ট গ্রামের চাষিরা পরিবেশ ন্ধব সবজি উৎপাদনের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই একটি ক্লাব গঠন করেন। তারা নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে থাকেন।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের শারিয়ালজোত গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাসায়নিক মুক্ত সবজি চাষ করছেন কৃষকরা। তাদের ক্ষেতে লালশাক, ডাটাশাক, শিম, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া সবজি দেখা যায়।

শুকুর আলী, হালিম ও আতিয়ার নামের ক্ষুদ্র চাষিরা জানান, রাসায়নিক সারের বিপরীতে জৈব সার ব্যবহার করছেন। এজন্য তারা গোবর, গাছের লতাপাতা ব্যবহার করে কম্পোস্ট তৈরি করে জৈব সার উৎপাদন করছেন। কীটনাশকের পরিবর্তে তারা নিজেরাই জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করছেন।

পেয়াজ রসুনের নির্যাস, ভাট ফুলের নির্যাস, নিম পাতার নির্যাসসহ আরও অনেক ধরনের উদ্ভিত থেকে তারা নির্যাস তৈরি করে সবজি খেতে স্প্রে করে থাকেন। পোকা মাকড়ের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য তারা হাত জাল ব্যবহার করেন। ফোরমোন ফাঁদে স্ত্রী পোকার গন্ধ যুক্ত করেন। এই গন্ধ পেয়ে অন্যান্য পোকারা এই ফাঁদে আটকে যায়। চাষিরা বলছেন পরিবেশবান্ধব সবজি উৎপাদনে খরচ কম। ফলনও ভালো হয়।

তারা আরও জানান, জৈব সার ব্যবহারে উৎপাদিত সবজি নির্ধারিত দোকানে পৌঁছে দেন। বিষমুক্ত সবজি চাষে শুধু পুরুষদের পাশাপাশি নারী কৃষকরাও চাষ করছেন। তারা সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বাড়ির আশপাশে এবং আঙিনা জুড়ে নানা ধরনের সবজি উৎপাদন করছেন। কৃষি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে উৎসাহিত হয়ে সফলতা পাচ্ছেন।

ক্ষুদ্র চাষি হাফিজা বেগম জানান, কৃষক মাঠ স্কুলে প্রশিক্ষণ নিয়ে এবার বাড়ির পাশের ১০ শতক জমিতে লাউ এবং মিষ্টি কুমড়া চাষ করি। আমার ৩০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। আমি কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করিনি। আমার নিজের পোষা ছাগল গরুর গোবর ব্যবহার করেছি। আর ভাটগাছের পাতা থেকে রস বানিয়ে গাছে ছিটিয়েছি।

তেঁতুলিয়া চৌরাস্তা বাজারের বিষমুক্ত সবজি বিক্রেতা হাসিবুল ইসলাম জানান, রাসায়নিক-কীটনাশক সার দেয়া উৎপাদিত শাক-সবজি পরিহার করে জৈব সারে আবাদকৃত সবজি বিক্রি করছি। দাম একটু বেশি হলেও দিনদিন ক্রেতা বাড়ছে, বিক্রি হচ্ছে ভালো।

এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক আবুল হাসনাত ও মোখলেসুর রহমান জানান, আমরা বিষাক্ত খাবার খেতে খেতে নানান রোগবালাইয়ে শিকার হচ্ছি। আমি চেষ্টা করছি, নিজের আবাদের পাশাপাশি বাজার থেকে নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি কিনতে। এটা সবারই করা উচিত।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, নিরাপদ খাদ্য মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। আমরা নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য থেকে পিছিয়ে আছি। এ চাহিদা পূরণের জন্য এটি একটি উত্তম পন্থা। আমরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করার জন্য সবজি চাষিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তাদের সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে কৃষক ক্লাব গঠিত হচ্ছে। এতে তারা নিজেরা সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য কৃষকরাও নিরাপদ সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
তেঁতুলিয়া,বিষমুক্ত
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close