ইফতেখার হোসাইন
নোবিপ্রবি গবেষণা
মুরগির ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে হতে পারে প্রাণঘাতী রোগ
ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যা মানবদেহে প্রবেশ করলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও টাইফয়েডের মতো প্রাণনাশক নানান রোগ হতে পারে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) গবেষকদের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
মুরগি বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে। পাশাপাশি মুরগির ফার্মের ব্যবসার মাধ্যমে অনেকে এ খাতে নিজেদের কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। সাধারণত ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগিতে পরিমিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু প্রান্তিক অনেক ব্যবসায়ী ও চাষিরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে অনুমোদনহীন অ্যান্টিবায়োটিক মুরগির খাদ্যে ব্যবহার করছেন। গবেষকদল ওইসব অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নিয়ে নিরীক্ষা চালান। তারা নোয়াখালীর ৩টি প্রান্তিক অঞ্চলের ফার্ম থেকে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির অন্ত্রের নমুনা সংগ্রহ করেন। সেখানে তারা মুরগির অন্ত্রে ৯ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে মোরগানিলা মরগানি, এন্টারোভেক্টর এবং ওল্ফারথিমনাস কাইটিনিক্লেসটিকার মতো প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়া বিদ্যমান। এ ব্যাকটেরিয়াগুলো বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মুরগির অন্ত্রে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়াসমূহ এরই মধ্যে বাজারে বিদ্যমান অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ৬৬ থেকে ১০০ শতাংশ প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে এবং মানবরোগ সৃষ্টিকারী এসব ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে দেশে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজে আসছে না।
নোবিপ্রবি বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শিপন দাশ গুপ্ত, শুভ চন্দ্র দাস ও বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আদনান মুনিম এ গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষক দলের প্রধান ড. শিপন দাশ গুপ্ত জানান, মুরগির অন্ত্রে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও টাইফয়েডসহ নানান ব্যাকটেরিয়া থাকে। আশঙ্কার বিষয় হলো সেগুলো প্রতিরোধে আমরা যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছি, তা এখন আর কাজ করছে না। কারণ ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। কাজেই ব্যাকটেরিয়া মুরগির শরীরেই রয়ে যাচ্ছে।
আর এসব ব্যাকটেরিয়া মুরগি কাটা বা ধোয়ার সময় যদি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও টাইফয়েডের নানান প্রাণঘাতী রোগ হতে পারে বলে জানান তিনি। ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষের কাটা বা ক্ষতস্থানের রক্তের সংস্পর্শে গেলে এ ব্যাকটেরিয়া মানুষকে আক্রান্ত করবে বলে মন্তব্য করেন ড. শিপন। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলগুলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কিউ-১ র্যাংকড জার্নাল প্লজ ওয়ানে প্রকাশিত হয়।
এসব ব্যাক্টেরিয়া দমনে বাজারে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকসমূহের প্রতিরোধী ক্ষমতা যাচাই করা হয়। সেখানে দেখা যায়, প্রায় সব অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেই মুরগির শরীরে থাকা ব্যাক্টেরিয়াগুলো প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, এই সব মুরগির ব্যাক্টেরিয়াতে জীবাণু বিরোধী চতুর্থ প্রজন্মের সর্বশেষ অ্যান্টিবায়োটিক ‘কলিস্টিন’ এর বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গবেষকদল মুরগির ব্যাক্টেরিয়াতে এসব অ্যান্টিবায়োটিক বিরোধী দায়ী জিনসমূহ শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
এছাড়াও ব্যাক্টেরিয়াগুলো মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করার সক্ষমতা রাখে কী না তা যাচাই করতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নানসহ অন্য একটি যৌথ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে তারা ‘ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া’ ব্যাক্টেরিয়ার জীবন রহস্য উন্মোচন করেন। গবেষণায় দেখা যায়, মুরগিতে প্রাপ্ত ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া মানবদেহে নিউমোনিয়া রোগ সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতা রয়েছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে মাছ, মাংসের দাম চড়া। সাধারণ মানুষ নিজেদের শরীরের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে মুরগির ওপর নির্ভরশীল। দাম কিছুটা নাগালের ভেতর হওয়ার নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরীব মানুষের প্রত্যাশিত ডিশ ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগি। কিন্তু গবেষকরা মুরগিতে পাওয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী মানবরোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা মুরগি কাটা ও ধোয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। অধিকন্তু পোল্ট্রি মুরগিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিমাত্রায় ব্যবহার বন্ধ না করা গেলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আরেকটি মহামারির সম্মুখীন হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
লেখক : সহকারী পরিচালক (তথ্য ও জনসংযোগ), নোবিপ্রবি
"