শতদল বড়ুয়া
দৃষ্টিপাত
বয়ঃসন্ধি : একটি ক্রান্তিকাল
বয়ঃসন্ধি একটি ক্রান্তিকাল। এ বিষয়ে আমরা কে কি ভাবছি? অনেকে ভাবি, অনেকে ভাবি না। কিন্তু ভাবা দরকার নিজের পরিবার তথা সংসারের স্বার্থে। ইংরেজি এডোলিসন্ট শব্দের অর্থ হলো- শৈশব থেকে যৌন পরিপক্বতা অর্জন করে যৌবনে পদার্পণ করা। এ সময়টুকুকে আমরা বয়ঃসন্ধিকাল বলতে পারি। যৌবন শুরুর কাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত সময়কালে কোনো ছেলে বা মেয়েকে কিশোর-কিশোরী বলা হয়।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ হচ্ছে কিশোর-কিশোরী। মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৩ ভাগের মধ্যে ৪৮ ভাগ কিশোরী এবং ৫২ ভাগ কিশোর। বাংলাদেশের বয়স কাঠামোতে বয়ঃসন্ধিকালীন জনসংখ্যা আধিক্য একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটা অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে এ ধরনের জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবাও তেমন সন্তোষজনক নয়। স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা এ ব্যাপারে খুবই সীমিত হলেও সরকারের সংশ্লিষ্টভাগ অহোরাত্র কাজ করে যাচ্ছে সাধারণ জনগণের কল্যাণে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১০ থেকে ১৯ বছর সময়কালকে বয়ঃসন্ধি বা কৈশোর হিসেবে ধরা হয়। তাই এ বয়সের ছেলেমেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত করা হয়। শৈশবের ঝুঁকি কাটিয়ে শিশুরা যখন বয়ঃসন্ধিতে পা বাড়ায় তখন তাদের অনেকটা সুস্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং অভিভাবকরা এদের স্বাস্থ্য ও মানসিক বিষয়ে তেমন মাথা ঘামায় না।
সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই বয়সীরা বিশেষ করে কিশোরীরা অত্যন্ত। অবহেলিত থাকে। কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে মেয়েরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। কারণগুলো হতে পারে- পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষার অভাব, নিম্ন সামাজিক মর্যাদা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যায় উদাসীনতা, কম বয়সে বিয়ে এবং সন্তান ধারণ ইত্যাদি।
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আইসিপি সম্মেলনে ১০-১৯ বছর বয়সিদের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রতি আইসিপি কিছু বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। ১. শৈশবের ঝুঁকি কাটিয়ে ওঠার পর এদের সুস্থ বলে পরিগণিত করা হলেও তাদের স্বাস্থ্য ও মানসিক সমস্যার প্রতি সামাজিক মনোযোগ একেবারে নেই বললে বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। ২. এরা বিশ্বসংখ্যার পাঁচভাগের একভাগ। ৩. এরা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, যৌনবাহিত রোগ এবং এইচআইভি/এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার অত্যধিক ঝুঁকিতে। ৪. এরা একই সঙ্গে দেশ ও জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।
আজকের প্রতিবেদনে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীর বিষয়ে সামান্যতম আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আমরা অভিভাবকরা এ বয়সিদের বেশি কিছু জানতে চাই না বা জানার চেষ্টা করি না বলে অনেক রহস্য তথা সমস্যা আমরা জানি না। আমি যা কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করছি, তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব পর্যায়ে সমান। একটি শিশুজন্মের পর থেকেই খুব ধীরগতিতে বাড়তে থাকে। একটা বয়সে হঠাৎ তাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এক্ষনে তাদের শিশুও বলা যাবে না, আবার বড়দের দলেও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। শিশুকালের পর মেয়েদের এ সময়ে শারীরিক ও মানসিক বহুবিধ সমস্যা এবং পরিবর্তন উল্লেখ করার মতো।
বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তনের ফলে কিশোর-কিশোরীদের মনে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, কৌতূহল, মনে চাঞ্চল্য এবং বিহ্বলতা দেখা দেয়। তারা এ সময় নিজেদের শরীর, চেহারা, আচার-আচরণ এবং পোশাক বিষয়ে অনেক সচেতন হয়। মানসিক এই পরিবর্তনগুলো প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ঘটতে থাকে। আমরা অনেকে হয়তোবা জানি না মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত একপ্রকার হরমোনের প্রভাবে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের যৌনবিষয়ক চিন্তা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গ এবং তাদের প্রতি নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়, বড়দের মতো আচরণ করতে ইচ্ছা পোষণ করে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ প্রবল হয়, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চায়, নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্যোগী হয়, লাজুক ও সংকুচিত ভাব দেখা দেয়, মনে নানা কৌতূহল সৃষ্টি হয়, নানা রকম
নতুন ধরনের ভালো লাগা, না লাগার প্রতিযোগী ভাব সৃষ্টি হয়। নিজের প্রতি অপরের বেশি মনোযোগ দাবি করে এবং স্নেহ-ভালোবাসা পেতে আকুল হয় ও আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করে। আবেগের তাড়নায় ক্ষেত্রবিশেষে বিপদের ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
মানুষের জীবনের ভিত রচিত হয় আসলে কৈশোরে। সারাজীবনের সুস্থতা অনেকখানী নির্ভর করে বয়ঃসন্ধিকালে অর্থাৎ কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে। এ বয়সে একজন কিশোর বা কিশোরী স্বাস্থ্য ও পারিবারিক জীবনের যে শিক্ষা পায় তা-ই সে পরবর্তী জীবনের পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতিফলিত করে। এ সময় তারা যদি কোনো ভুলের স্পর্শে যায়, তা কিঞ্চিৎমাত্র ভুল করে বসে, তাহলে তার জীবনের বিকাশকে করে মারাত্মকভাবে ক্ষতি এবং ফুলের মতো জীবনকে ঠেলে দেয় অতল সমুদ্রে, যেখান থেকে আর শত চেষ্টা করেও উঠে আসা যায় না।
বয়ঃসন্ধিকালে বাস্তবতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা কম থাকে, যৌন আচরণের ফলাফল সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না থাকা, অন্যের প্ররোচনায় ধ্বংসের দিকে ধাবিত হওয়া, নিজে সব জানার ভান করা, চিন্তা ও কর্মে দুঃসাহসিক কিছু করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়, প্রজনন, স্বাস্থ্য, সংক্রমণ রোগ এবং অন্যান্য রোগ সম্পর্কে ধারণা কম থাকা, মাদকদ্রব্য নেশায় আসক্ত হতে পারে, স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলো গোপন রাখার চেষ্টা করে এবং দুর্ঘটনা, সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে।
আমাদের সমাজে যে ধরনের অনাচার হচ্ছে, যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সবকিছুর মূলে কিন্তু একটা বিষয় সক্রিয়। তা হলো বয়ঃসন্ধিকালে পরিবার-পরিজন থেকে উপযুক্ত শিক্ষা না পাওয়া, মুরব্বিদের আদেশ-উপদেশ মেনে না চলা, নিজেকে সবজান্তা মনে করা এবং কোনো মতামতকে প্রাধান্য না দেওয়া। তাই বয়ঃসন্ধিকালে স্বাস্থ্য, শিক্ষা বিশেষ করে প্রজনন শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রত্যেক কিশোর-কিশোরীর অভিভাবক, সমাজের নেতৃস্থানীয়রা সবারই বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অপরিহার্য বিষয়। এর ব্যতিক্রম হলে আমাদের আগামী প্রজন্ম শারীরিক ও মানসিকভাবে বিকশিত হওয়ার পথ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
টেকসই ঘর নির্মাণ করতে হলে আগে প্রয়োজন সঠিক ফাউন্ডেশন। ঘর বা বাড়ি নির্মাণ করার শুরু থেকেই যদি প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দ্বারা কাজ করা না হয়, তাহলে ওই বাড়ি সারাজীবনই বাড়িওয়ালাকে ভোগাবে নানা দিক দিয়ে। মানুষের জীবন গড়তেও ঠিক একই নিয়ম অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। জীবনের ভিত রচনায় পেশিশক্তির আঁচড় লাগলে সেও দিন দিন প্রসারণই ঘটাবে। ক্ষত শুকানোর কোনো দাওয়াই কাজ করবে না।
অভিভাবকরা কিশোর-কিশোরীদের জীবনের ভিত গড়ার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দিলে, আন্তরিকভাবে বন্ধুর মতো মনের অবস্থা বুঝে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে তাদের বিপদগামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই অভিভাবকদের উচিত কৈশোরে ছেলেমেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনকালে তারা যেন সঠিক যত্ন পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। তাদের পরিবর্তনের এই ক্রান্তিলগ্নে সত্যিকারের বন্ধু হতে পারা মানে জীবন গড়ার ভিত রচনায় সাফল্য অর্জন করা। সবার সহযোগিতায় কিশোর-কিশোরীদের প্রজননবিষয়ক ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কারসমূহ অপসারিত করে সঠিক প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক জ্ঞান দেওয়া অবশ্যই সম্ভব। এতে তারা যেমন সুস্থ থাকবে, তেমনি দেশ ও জাতি পাবে এক সুস্থ-সবল আগামী প্রজন্ম।
বয়ঃসন্ধি বিষয়ে লিখতে গেলে আরো অনেক বিষয়ে জ্ঞাত করানো যেতে পারত। বয়ঃসন্ধি বিষয়ে মোটামুটি অবতারণা করার মূলে রয়েছে বর্তমান সমাজের অবক্ষয়। সুস্থ-সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে কিশোর-কিশোরীদের মতামতকে উপেক্ষা না করে বরং ভালো খারাপ দুদিকই তাদের বোঝানোর দায়িত্ব আপনার আমার সবার। আশা করি, এ বিষয়ে সবার সহযোগিতাই প্রাধান্য পাবে বেশি।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"