আল মামুন
দৃষ্টিপাত
চুরি-ছিনতাইরোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
রাজধানী ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসেই ৪৬১টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। মতিঝিল, মিরপুর ও গুলশান এলাকাগুলোতে চুরি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। রাজধানীবাসী এখন এক অদৃশ্য আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। চুরির ঘটনা শুধু আর্থিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; অনেক ক্ষেত্রে তা প্রাণহানির মতো নৃশংসতায় রূপ নিচ্ছে। ফলে নাগরিক নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তাই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন একটি সমন্বিত সামাজিক এবং প্রশাসনিক উদ্যোগ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চুরি ও অন্য ছোটখাটো অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ কাজ করছে। প্রথমত, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য অন্যতম প্রধান কারণ। সমাজের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে অনেকেই জীবনের তাগিদে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে হতদরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা অপরাধের দিকে ধাবিত হচ্ছে জীবনযাত্রা বজায় রাখার জন্য।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি অপরাধের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হামলা, অস্ত্র লুট এবং কারাবন্দিদের পলায়নের মতো ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। পুলিশ বাহিনীর কার্যক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যার সুযোগ নেয় অপরাধীরা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও তা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তৃতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমিত সক্ষমতা। পুলিশের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম সামাল দিতে গিয়ে সাধারণ অপরাধ দমন কঠিন হয়ে পড়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলেন, ছোটখাটো অপরাধ যেমন চুরি, এগুলো অনেক সময় অবহেলিত হয়, ফলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি চুরি হয়েছে মতিঝিল এলাকায়, যেখানে ৭৯টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। মতিঝিল একটি বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় এখানে অফিস, ব্যাংক এবং অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এ ছাড়া মিরপুরে ৭৭টি এবং গুলশানে ৬৩টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। এই দুই এলাকায় জনঘনত্ব বেশি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাসিন্দাদের বসবাস থাকায় চোরেরা এসব এলাকা টার্গেট করছে। চুরি করতে গিয়ে চোরের মৃত্যু এবং চুরিতে বাধা দেওয়ার কারণে নৈশপ্রহরী খুন হওয়ার ঘটনাগুলো এই সমস্যার ভয়াবহ দিকটি প্রকাশ করে। ৭ অক্টোবর ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে চুরি করতে গিয়ে একজন চোরের মৃত্যু হয়। আবার ১০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় নৈশপ্রহরী রবিউল ইসলামকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই ধরনের ঘটনাগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। চুরির ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চুরি রোধে টহল এবং ফুট পেট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে। মামলাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং দাগি অপরাধীদের ধরতে অভিযান চলছে। তবে এই প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা প্রয়োজন এবং পুলিশের কর্মপরিধি আরো সম্প্রসারণ করা উচিত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তার পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধ প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বিশেষ সহায়তা এবং পুনর্বাসন প্রকল্প চালু করা দরকার। চুরি প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিংব্যবস্থা জোরদার করা যেতে পারে। এতে সাধারণ জনগণ এবং পুলিশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়বে এবং অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। দারিদ্র্য হ্রাস এবং বৈষম্য দুরকরণে সরকারকে আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ এবং নিম্নবিত্তের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভর্তুকি দেওয়া অপরিহার্য। একইসঙ্গে বেকারত্ব কমাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ চালু করা উচিত। এর পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে, যাতে তরুণসমাজ সঠিক মূল্যবোধে বেড়ে ওঠে। রাজধানীতে চুরি প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এবং আবাসিক ভবনগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করা জরুরি। সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে অপরাধীদের দ্রুত শনাক্ত করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। এ ছাড়া পুলিশের টহলব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন এবং ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।
চুরি এবং অন্য অপরাধ প্রতিরোধে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি, সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রম, দারিদ্র্য বিমোচন এবং বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ, প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তাব্যবস্থা, রাজধানীবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধুমাত্র পুলিশের কাজ নয়; এটি আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব। প্রশাসন, নাগরিক সমাজ, এবং প্রতিটি সচেতন ব্যক্তির সমন্বিত প্রয়াসই পারে ঢাকাকে একটি নিরাপদ নগরীতে পরিণত করতে। অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রতিটি নাগরিককে নিজ দায়িত্বে সজাগ থাকতে হবে। এভাবেই আমরা চুরি এবং অন্য ছোটখাটো অপরাধ মোকাবিলা করে একটি নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ নগরী গড়ে তুলতে পারি।
অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তরুণসমাজকে চুরির মতো অপরাধ থেকে দূরে রাখতে ছোটবেলা থেকেই সঠিক নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন। পরিবারে যদি সৎ জীবনযাপনের আদর্শ গড়ে তোলা যায় এবং মা-বাবা সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পারেন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। অনেক সময় আর্থিক সংকটের কারণে পরিবারের সদস্যরা অপরাধের দিকে ঝুঁঁকে পড়েন। তাই দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য সরকারি সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরো সম্প্রসারিত করা উচিত। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের ওপর জোর দেওয়া গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করা যাবে। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং কাউন্সেলিং সেশন চালু করলে তাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ বা লোভের মতো নেতিবাচক আবেগ কমবে এবং অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
"