হৃদয় পান্ডে
মুক্তমত
গণতন্ত্রে যুবসমাজের ভূমিকা : নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনসম্পৃক্ততা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ, যা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি। গণতন্ত্রে জনগণের মতামত এবং অংশগ্রহণের গুরুত্ব অপরিসীম। এবং এ প্রক্রিয়ায় যুবসমাজ অন্যতম শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত হয়। যুবসমাজের শক্তি এবং শক্তিশালী উপস্থিতি গণতন্ত্রের মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলে। কারণ তারা দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্বে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উদ্ভাবনী চিন্তা ও প্রযুক্তির প্রতি দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসেই এর প্রমাণ মেলে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় যুবসমাজ ছিল বিপ্লবী শক্তি এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেশের স্বাধীনতা, মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অমূল্য অবদান রেখেছে।
বর্তমান সময়ে যুবসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে না, বরং তারা সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করে। তরুণদের ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং সুশাসনের পক্ষে প্রচার চালানো একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক, তেমনি অন্যদিকে তারা রাজনীতির মূলধারায় আরো নিবিড়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলের কাঠামোয় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং নতুন নেতৃত্বের বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে সামনে এসেছে। এই পরিবর্তন এবং উন্নয়নের জন্য শুধু তরুণদের ভোট দেওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে এবং গণতন্ত্রকে আরো কার্যকর, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য তাদের সমষ্টিগত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এই প্রজন্মের তরুণরা চাইলেই দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরো শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং ন্যায়সঙ্গত করে তুলতে পারে। তাদের সামর্থ্য, উদ্যম এবং নতুন চিন্তা-ভাবনা দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো হয়ে উঠতে পারে। তাই তরুণদের শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য হওয়া বা ভোটদানই নয়, বরং সমাজের বিভিন্ন স্তরে তাদের অবদান রাখতে হবে। এর মাধ্যমে তারা একদিকে যেমন গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করবে, তেমনি অন্যদিকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ এবং স্বনির্ভর জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
যদিও যুবসমাজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। প্রথমত, রাজনৈতিক কাঠামোতে তরুণদের সুযোগ সীমিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরোনো নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মকে সুযোগ দিতে চায় না। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং অপসংস্কৃতি তরুণদের হতাশ করে এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। তৃতীয়ত, শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের সংকট এবং সামাজিক বৈষম্য তরুণদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাছাড়া, তরুণদের মধ্যে অনেক সময় রাজনৈতিক জ্ঞান এবং সচেতনতার অভাব দেখা যায়। এর ফলে তারা প্রায়ই ভুল তথ্যের শিকার হয় এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুবসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, তাদের জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। যুবসমাজ যখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায়, তখন তাদের সামনে কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। বিশেষত, দলগুলোকে তরুণদের জন্য নেতৃত্ব তৈরি করার একটি সুসংগঠিত কর্মসূচি চালু করতে হবে, যাতে তারা সংগঠনের মধ্য দিয়ে নিজেদের দক্ষতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলি প্রদর্শন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় গণতন্ত্র, সুশাসন এবং নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এই পাঠগুলো তরুণদের না শুধুমাত্র তাদের অধিকার এবং কর্তব্য সম্পর্কে জানাবে, বরং তাদেরকে সমাজের পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। শিক্ষার পাশাপাশি, বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার এবং আলোচনা সভার মাধ্যমে তরুণদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব। এ ছাড়া, অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে, যা তাদেরকে আরো কার্যকরভাবে সমাজের নানা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করবে। তৃতীয়ত, সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান যুগে সামাজিক মাধ্যম তরুণদের মতামত প্রকাশ এবং রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেওয়ার একটি শক্তিশালী ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই সামাজিক মাধ্যমে তাদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুবসমাজের অংশগ্রহণ একটি জাতির উন্নতির জন্য অপরিহার্য। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তা, কর্মক্ষমতা এবং দায়িত্ববোধ একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বড় সম্পদ। বাংলাদেশে তরুণদের সম্পৃক্ততা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে এটি শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করতে হলে তরুণদের অংশগ্রহণ এবং দায়িত্বের বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ
"