মো. ইলিয়াস
মুক্তমত
মাধ্যমিক থেকেই চাই কর্মমুখী শিক্ষা
শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড, আর সেই মেরুদণ্ড তিলে তিলে ক্ষয় করছে সার্টিফিকেটীয় শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া মানব জীবন অপূর্ণ। কথায় আছে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সেই জাতি তত বেশি উন্নত। কিন্তু যে শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না, সে শিক্ষা অর্থহীন। এধরনের শিক্ষায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা বাড়তে থাকে। জীবনভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা।
কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বলা হয় সেই শিক্ষা, যা জীবনের বাস্তব কর্মের সঙ্গে প্রায়োগিকভাবে সম্পৃক্ত। এটি কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা, যা দেশের বাস্তব সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে তৈরি করা হয়। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন পেশায় নিজেকে দক্ষ করে তুলতে পারে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে যে শিক্ষাব?্যবস্থা প্রচলিত তা প্রায় এক যুগ ধরে প্রশ্নবিদ্ধ। কি দিচ্ছে এই শিক্ষা? কি লাভ হচ্ছে এই শিক্ষা নিয়ে? যেখানে একজন ছাত্র ১৭-১৮ বছর ধরে মাস্টার্স শেষ করার পর চাকরির পরিক্ষায়, ভাইভাতে তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে অভিজ্ঞতা আছে কি? কম্পিউটার জানা আছে? তাহলে ১৭-১৮ বছর ধরে যে মাস্টার্স শেষ করল ক্লাস বাই ক্লাস সর্বোচ্চ রেজেল্ট করল তার কি কোনো মূল?্য নেই? বাস্তবে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এসবের কোনো মূল?্যায়ন করা হচ্ছে না?
দেশের সরকারি অফিস থেকে শুরু করে শীর্ষ স্থানীয় বেসরকারি অফিসগুলোতেও দেখা হয় অভিজ্ঞতা, প্রাধান্য দেওয়া হয় কম্পিউটার শিক্ষাকে।
বিবিএসের হিসেবে আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ?্যা প্রায় ২৬ লাখ। তার অন?্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এই কর্মমুখী শিক্ষা এখনো পর্যন্ত অবাস্তবায়ন। দেশের সরকারি, বেসরকারি অফিসের শূন্য পদের থেকেও দেশে শিক্ষিতের হার বেড়ে চলেছে ফলে চাকরির বজার এখন সংকটকের মুখে, ফলে প্রতিবছর বাড়ছে লাখ লাখ বেকারের সংখ্যা।
বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে কর্মমুখী শিক্ষার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এটি প্রায়োগিক ও বিজ্ঞানসম্মত না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেরানিগিরির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষে বেকার থাকে। শুধু ডিগ্রির পেছনে ছুটে প্রকৃত দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় বেকারত্বের অভিশাপ ঘিরে ধরছে শিক্ষার্থীদের। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও তারা তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এ সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য কর্মমুখী শিক্ষা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মূলত মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভরশীলতা দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাস করার জন্য যা মুখস্থ করে, তা বাস্তব জীবনে খুব একটা কাজে আসে না। পুঁথিগত শিক্ষাজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে অনেক ক্ষেত্রে এটি শিক্ষার্থীদের পঙ্গুত্ব বয়ে আনে। ফলে দক্ষ পেশাজীবী, কারিগর, বিজ্ঞানী তৈরির প্রয়োজনীয়তা পূরণে এ শিক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ। ঔপনিবেশিক শাসনামলের প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীরা কেরানি হওয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকে।
দেশের প্রতে?্যকটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি অনেক মাদরাসায়ও রয়েছে কম্পিউটার ল?্যাব। কিন্তু সেখানে পুরো বছরজুড়ে শেখানো হয় কম্পিউটার কীভাবে অন-অফ করতে হবে, শেখানো হয় কীভাবে মাউস ধরতে হবে। যুগের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব?্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। যদিও শিক্ষাব?্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ‘স?্যাডলার কমিশন’, ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’, ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন’, ‘কাজী জাফর/বাতেন কমিশন’, এবং সর্বশেষ মজিদ খানের শিক্ষানীতি গঠন করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বা বাস্তবক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি সাধিত হয়নি। তাই যদি হবে তাহলে দেশে কেন এই বেকারত্ব? কেন কর্মের জন?্য এতক হাহাকার? কেন এতদিন কর্মমুখী শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হলো না? বর্তমান শিক্ষাব?্যবস্থা আমাদেরকে শুধু ডিগ্রি দেয় সিজিপিএর সার্টিফিকেট দেয়, কোনো কর্মের সুযোগ তৈরি করে দেয় না, দেয় না চাকরি বা কোনো কাজ, হয় না কর্মসংস্থান।
বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাব?্যবস্থার দিকে তাকালে তাদের পরিকল্পিত এবং কর্মমুখী শিক্ষার বাস্তব কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়। উন্নত দেশের শিক্ষাব?্যবস্থায় কেরানি হওয়ার সুযোগ নেই। আছে বিজ্ঞানী হওয়ার এবং কর্মের মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার সুযোগ। ব্রিটেন, আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড এসব দেশ কর্মমুখী বা উৎপাদনমুখী শিক্ষাব?্যবস্থা চালু করে নিজেদের ভাগ?্যকে প্রসন্ন করেছে। বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে তারা আজ উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করছে। অথচ তাদের দিকে তাকালে খুব সহজেই বোঝা যায় এ সময়ে এসেও আমরা তাদের থেকে কয়েক যুগ পিছিয়ে আছি।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কর্মসংস্থানের চাপ বাড়ছে। এতে করে কর্মসংস্থানহীন যুব শক্তির সংখ্যাও বাড়ছে। এই যুব শক্তিকে কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ করে
তুলতে পারলে আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। সেজন?্য দেশের পাঠ?্যপুস্তকগুলোতে গঠনমূলক ও উৎপাদনমুখী শিক্ষাব?্যবস্থার পাঠক্রম চালু ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী
বাংলা বিভাগ, রুপসা কলেজ
খুলনা।
"