অলোক আচার্য

  ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

পাঠক কেন বই কিনবেন

ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর মহৎ লোকের সঙ্গে আলাপ করা। এটি ফরাসি দার্শনিক র‌্যনে দেকার্তের বিখ্যাত উক্তি। বই পড়া নিয়ে শত শত উক্তি রয়েছে, কিন্তু ভালো বই পড়া নিয়ে এত কথা নেই। বই কোনো নির্দিষ্ট দেশের নয়, কোনো নির্দিষ্ট ভাষার নয়; বই সবার। বই নিঃসন্দেহে মানবসভ্যতার জন্য মঙ্গলদায়ক, তবে একটি মানসম্পন্ন বই যা সাহিত্যের বিচারে উত্তীর্ণ বা কাছাকাছি, সেই বইয়ের সঙ্গে গড়পড়তা বইয়ের বিরাট ফারাক রয়েছে। একটি বই বই হয়ে উঠতে কয়েকটি ধাপ পারি দিতে হয়। কয়েক হাত ঘুরতে হয়। বেশ কিছুটা সময়ের দাবিদার প্রতিটি বই। বই নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, এটা আমাদের ভাষার মাস, বইয়েরও মাস বটে! কারণ সারা বছর বই প্রকাশ এবং বই কেনায় কচ্ছপগতি থাকলেও এ মাস ঘিরে বই প্রকাশ এবং বই বেচাকেনার গতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। যদিও একটি সভ্য জাতির ক্ষেত্রে হওয়া উচিত ছিল উল্টোটা। সারা বছরই বই প্রকাশিত হবে, পাঠক কিনবেন, পড়বেন এবং সমালোচনা হবে। এটা একটা সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতি বাংলাদেশে নেই।

ফেব্রুয়ারি মানেই রাজধানীতে বইয়ের উৎসব। চারদিকে নতুন বইয়ের গন্ধ ভাসে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে বইমেলার আয়োজন দীর্ঘদিন থেকেই জাতীয় সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে এটি আর এখন শুধু একটি মেলা নয়। অনেক বইপ্রেমী সারা বছর এ বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন। যত দিন যাচ্ছে, ততই জমে উঠছে বাঙালির প্রাণের বইমেলা। পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের এক মহামিলন মেলায় রূপ নেয় এ বইমেলা।

বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক। সাহিত্য হলো দেশের মননশীলতার প্রাণ। আর সাহিত্যচর্চার এবং বিকাশের অন্যতম কেন্দ্র হলো বইমেলা। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন- বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। এ কথা ঠিক হলেও প্রশ্ন হলো, পাঠক কেন বই কিনবেন বা কোন ধরনের বই কিনবেন? বইকে অন্য পণ্যের সঙ্গে তুলনা না করা গেলেও আমরা যখন কোনো পণ্য কিনি, তখন ভালো মানের পণ্যই কিনি। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। তবে বইয়ের ক্ষেত্রে সেটা আশা করি কীভাবে? আমরা যদি আশা করি, বইমেলায় দর্শনার্থীরা আসবেন এবং একটা করে বই কিনে বাড়ি ফিরবেন, তাহলে সেটা উচিত হবে না। কারণ পাঠক তার পছন্দের বই না পেলে কেন বই কিনবেন?

সারা বছর সাহিত্যচর্চার খবর নেই, বইমেলায় বই প্রকাশ করেই সারা বছরের সাহিত্য উদ্ধার করার মতো লেখক, কবি এবং প্রকাশক অনেক আছেন। হাজারো বই প্রকাশিত হচ্ছে। কী মানের বই মেলায় আসছে, আর তার কয়টিই বা শেষ পর্যন্ত বাজারে থাকছে, সেই খোঁজ আর কেউ রাখছেন না। অধিকাংশ বই চলে যাচ্ছে বাতিলের কাতারে। তাহলে এত এত বই লিখে, পকেটের টাকা দিয়ে ছাপিয়ে কী লাভ হলো, যদি তার সাহিত্যিক মানই না থাকল। ভালো লেখকের পেছনে প্রকাশকেরও দায় বা দায়িত্ব থাকে। যেনতেন লেখা মুদ্রিত করে বই বানিয়ে বিক্রি করে একজনকে লেখক আখ্যায়িত করার কাজটি তো প্রকাশকই করেন। যদি ভালো লেখক না হতে পারা যায়, তিনি কীভাবে একটি ভালো বই পাঠককে উপহার দিতে পারেন? পাঠকের বই কেনার প্রশ্ন তো আরো পরে আসবে?

বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা ভালো খবর। তবে কথা হলো, প্রতি বছরই অভিযোগ থাকে- মেলায় প্রচুর বই থাকলেও মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা অনেক কম। এটা আসলে অভিযোগ নয় বরং পাঠকের পক্ষ থেকে অনুযোগ। এই অনুযোগ কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে। এবারের বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট এলাকা জুড়ে আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলা শেষে এটা হিসাব করা হবে যে, কত টাকার বই বিক্রি করা হয়েছে। এটা বাণিজ্যের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বইচর্চা বা সাহিত্যের জন্য সুখকর নয়। কারণ যদি এটা হিসাব করা হতো যে, মেলায় কতটি বই মানসম্পন্ন বা এসব বইয়ের লেখক কে, তাহলে একটা কথা ছিল। এটা হয়তো কোনো দিন হবে না- মেলার পরিধির কথা চিন্তা করেই।

এ কথা সত্যি, বইমেলার মতো বিশাল আয়োজন একটি সুস্থ পরিবেশের ধারক। এই পরিবেশ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা জোগায়। বইমেলার কেন্দ্রবিন্দু হলো বই। আর বইয়ের কেন্দ্র হলো পাঠক। পাঠক যদি বই না পড়েন তাহলে বই প্রকাশ মূল্যহীন।

সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে বদল হয় বইয়ের ধরন। কিন্তু বদলায়নি বইয়ের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। নতুন-পুরাতন লেখক-কবি-প্রকাশক, মেলার দর্শক- সবাই উপস্থিত হন। বইমেলায় আসা থেকে শুরু করে বই বিক্রি করাই শেষ কথা নয় অথবা মেলার সার্থকতা নয়। মিলনমেলায় সবাই একত্র হওয়াটাও উদ্দেশ্য। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ- এ যেন আমাদের আত্মার সঙ্গে মিশে যায়। আজও আত্মার সঙ্গে মিশেই রয়েছে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করে মানুষের আত্মার খোরাক জোগাতে থাকে। তৈরি হয়েছে আলাদা পাঠক শ্রেণি। গল্পের বা উপন্যাসের বই পড়তে পড়তে কত বইপড়ুয়াদের রাত ভোর হয়ে যায়। এসব পড়ুয়া বইপ্রেমীর হাত ধরে তৈরি হয় বইয়ের সংগ্রহশালা। সেসব সংগ্রহশালায় থরে থরে শোভা পায় পাঠকের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে বইপ্রেমীরা প্রিয় লেখকের বই কেনার জন্য ছুটে আসেন। এ এক আত্মিক বন্ধন। এই বন্ধন গড়ে উঠে বইমেলা কেন্দ্র করে। আমাদের দেশের আজকাল বই নিয়ে চিত্রটা বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নতুন লেখক বইমেলাকেন্দ্রিক। এমনকি বই কেনাটাও সেই বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সারা বছর তেমন নতুন বইয়ের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বইমেলা এলেই বই প্রকাশের হিড়িক লেগে যায়। তা হোক। মেলায় এমনটাই হবে। তবে বই নিয়ে এমন আগ্রহ যদি সারা বছর থাকত, তাহলে বেশ ভালো হতো।

মাসের শেষদিকে প্রচুর বই আসে। এসব বই এত দ্রুত করতে হয় যে, বানান ভুল এবং বিভিন্ন অসংগতি থাকে। অথচ একটি বইয়ের পেছনে যে শ্রম দিতে হয়, তা কেউ দিতে চান না। কারণ এই সময়ে হাতে প্রচুর কাজ প্রকাশকের। তারপর আবার প্রতি বছর কোত্থেকে সব প্রকাশনী এসে হাজির হয় বই প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, যাদের সারা বছর দেখা পাওয়া যায় না। একটি বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বানান দেখা, প্রচ্ছদ, বইয়ের গেটআপ ইত্যাদি নানা বিষয় রয়েছে, যার দেখভালে সময় দরকার হয়। যখন একটি জায়গায় খুঁত থাকে, তখন তা একটি অসম্পূর্ণ মানহীন বইয়ের কাতারে নাম লেখায়। এত মানহীন বই দিয়ে কী করব আমরা? লেখার মানের কথা না হয় বাদই দিলাম! হঠাৎ করে আসা লেখক-কবির অনেককেই পরে সাহিত্যচর্চায় দেখা যায় না। তবু নতুন লেখক আসছে, বহু প্রকাশনী গড়ে উঠছে এবং এর প্রসার লাভ হচ্ছে, এটাই প্রশান্তির। অনেক প্রকাশনী আছে, যারা বই বের করার জন্য মুখিয়ে থাকে। বই বিক্রি না হলে তো পুরোটা লোকসান। লেখক নিজের টাকা দিয়ে বই বের করেন। অনেক লেখক-কবি প্রতি বছর বই বের করেন। কিন্তু তারা পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে ব্যর্থ। হাতে গোনা কয়েকজন লেখক আজ পাঠক টানতে পারছেন।

সাহিত্যের মান রক্ষা করাটা জরুরি। যারা লেখালেখির জগতে নতুন, তাদের একটা বিষয় অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে- সাহিত্য নিয়মিত চর্চা করতে হবে। হুট করে বই প্রকাশ করার চেয়ে সময় নিয়ে লেখালেখিতে আরো মজবুত ভিত্তি করে তারপর প্রকাশে যাওয়া উচিত। সাহিত্যচর্চায় ধৈর্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত চর্চা ছাড়া যেমন কোনো কাজই সফলতা অর্জন করা সম্ভব না, তেমনি সম্ভব না সাহিত্যেও। বইমেলা সব বিভেদ দূর করে বাঙালির প্রাণের সঞ্চার করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলা আরো বিস্তৃত হচ্ছে। বইমেলা বাঙালির ভাষাচর্চারও জায়গা। বই বেশি বেশি পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। বইমেলায় কার কতটি বই প্রকাশ হয়েছে, সেটি বড় কথা নয়। মূলত মানসম্পন্ন বই প্রকাশিত হয়েছে কতটি, সেটি বড় কথা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close