মাসুম বিল্লাহ, দুর্গাপুর (নেত্রকোনা)

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

দুর্গাপুরের পাহাড়ে পানির কষ্ট

সীমান্তবর্তী নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলায় পাহাড়ি গ্রামগুলোয় শুকনো মৌসুমে পানির সংকট পুরোনো। কিন্তু এবারের তীব্র তাপপ্রবাহে সেই সংকট এতটাই তীব্র হয়েছে যে, সেখানকার প্রতিটি ঘরে এখন পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। পাহাড়ি ঝরনার ছড়া ও পুকুরের ঘোলা পানিতে মিটছে তেষ্টা ও যাবতীয় কাজকর্ম।

দুর্গাপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন ও কুল্লাগড়া ইউনিয়ন সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানকার ১০ থেকে ১২টি গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের বাস। তাদের কষ্টের অপর নাম পানি। পাহাড়ি ঝরনা ছড়া ও পুকুরের দূষিত পানি দিয়ে চলে রান্নাবান্না, গোসলসহ সব ধরনের কাজ। সেই পানিই পান করতে হয় তাদের। এতে দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বর্তমানের তাপপ্রবাহে এসব গ্রামের হাজারো মানুষের কষ্ট এখন চরম আকার ধারণ করেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সদর ইউনিয়নের গোপালপুর, ভবানীপুর, ফান্দা, বারমারী, ভরতপুর, গাজিকোনা গ্রামসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি পাহাড়ি গ্রামে শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাধারণ নলকূপ দিয়ে আর পানি আসে না। এজন্য তারা বাধ্য হয়ে পুকুর বা পাহাড়ি ছড়ার পানি খেতে হয়। আর এতে পেটের অসুখ, চর্ম রোগসহ নানান রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। ওই গ্রামগুলোর হতদরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের পক্ষে গভীর নলকূপ বসানো কিংবা গভীর কুয়া তৈরি করা সম্ভব নয়। গ্রামে দু-একজন অধিক অর্থ ব্যয় করে সাবমারসিবল বসালেও বেশির ভাগ মানুষের ভাগ্যে জুটছে না বিশুদ্ধ পানি।

এদিকে গত কয়েক বছর ধরে পানি পেতে হতদরিদ্র পরিবারগুলো তিন চাকের রিং বসিয়ে অগভীর কুয়া তৈরি করে খাবার পানি সংগ্রহ করলেও শুকনো মৌসুমে সেসব কুয়াও থাকছে পানিশূন্য। কোনো কোনোটাতে পানি থাকলেও সেটা খাওয়ার অনুপযোগী। একটু ভালো পানির আশা করলেও দূরদূরান্ত থেকে কাঁধে করে বয়ে এনে পান করতে হয়।

জানতে চাইলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানায়, তাদের পানির খুবই কষ্ট। পাহাড়ি ছড়ার পানি আর পুকুরের ঘোলা পানিই এখন খেতে হচ্ছে। তাও দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আনতে হয়। সরকারিভাবেও কোনোরকম সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা।

দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নের ভরতপুর গ্রামের আদিবাসী নারী বুবু মারাক। তিনি হতদরিদ্র মানুষ। তার বাড়িতে নলকূপ না থাকায় পানির জন্য সারা বছরই তাদের পানির কষ্ট। তিনি বলেন, আমরার কল (টিউবওয়েল) নেই। আমরা অনেক আগে থাইকা পাহাড়ের ঝরনার ছড়ার পানি খাই। রান্নাবান্নাসহ সব কাজ করি। খালি আমি না সবারই এই অবস্থা।

একই এলাকার প্রবন্দ হাজং বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি ছড়ার পানি ব্যবহার করেছি। এই পানি খেয়ে অসুস্থ হতে হয়েছে অনেকবার। এখন একটু ভালো পানি খাওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ করে বাড়ির সামনে সাবমারসিবল বসিয়েছি।

বারোমারি গ্রামের হারিজ উদ্দিন বলেন, আমার বাড়িতে একটি নলকূপ আছে। কিন্তু তাতে পানি আসে না। বাধ্য হয়ে প্রতিদিন পুকুরের পানি ছাঁকনি করে তা দিয়েই রান্নাবান্না ও পান করা চলে। পানির জন্য খুবই কষ্ট করতে হচ্ছে।

স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক রেগুলার মানকিন বলেন, আমাদের পানির খুবই অভাব। পাহাড়ি ছড়ায় গর্ত করে সে জায়গা থেকেই পানি সংগ্রহ করি সবাই। কিন্তু এই পানি বিশুদ্ধ নয়। এতে নানারকমের রোগবালাই দেখা দেয়। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।

সদর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য রীতা নকরেক বলেন, আমাদের গ্রামে পানির তীব্র সংকট। পানির অভাবে গোসল, রান্নাবান্না কাপড়-চোপড় পরিষ্কারসহ নিত্যদিনের কাজে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একদিকে যেমন পানির অভাব অন্যদিকে এবারের তীব্র গরমের কারণে পাহাড়ি ছড়া বা পুকুরের পানি দিনের বেলায় অনেক গরম থাকে। রাতে আনতে হয়। সরকারিভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে এলাকার মানুষের উপকার হতো।

দুর্গাপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রামগুলোয় গভীর টিউবওয়েল বসাতে হলে পাথর সরিয়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ ফুট নিচে পর্যন্ত যেতে হয়। তার জন্য ব্যয়বহুল খরচ যা সেখানকার মানুষের কষ্টসাধ্য। তবে বিকল্প হিসেবে গভীর রিং টিউবওয়েল বসানো যায় তাহলে আদিবাসীদের সুপেয় পানির সমস্যা কিছুটা দূর হবে।

এ ব্যাপারে দুর্গাপুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, পাহাড়ি এলাকায় পাথরের জন্য গভীর নলকূপ বসানো সম্ভব হয় না। পাহাড়ি এলাকায় পানি সংকট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা এই পানির সংকট দূর করতে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতে চাচ্ছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানিয়েছি। এ নিয়ে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম রকিবুল হাসান বলেন, পানির সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ওই গ্রামগুলোয় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close