রফিকুল নাজিম

  ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ভূতের সঙ্গে বিটুলের ডিনার

শালবনের ভেতরের পোড়াবাড়িটা খুব দূষিত। এই বাড়িকে নিয়ে হোতাপাড়া গ্রামে নানা রকম গাল-গপ্পো প্রচলিত আছে। একসময় এই বাড়িতে নাকি এক পাষণ্ড জমিদার বসবাস করতেন! খাজনার জন্য প্রজাদের ধরে নিয়ে এসে খুব অত্যাচার করতেন। তার নির্দয় অত্যাচারে দু-একজন মারাও যেতেন। গ্রামের মুরব্বিরা তাই মনে করেন- জমিদারের নির্যাতনে মারা যাওয়া সেই প্রজারা এখন ভূত হয়ে গেছে। সেই মৃত প্রজাদের আত্মা এখন প্রেতাত্মা হয়ে গেছে। একবার নাকি গ্রামের এক সাহসী যুবক সন্ধ্যার পর ওই বাড়িতে ঢুকে দেখে ভূতরা বসে সভা করছে। মানুষকে ভয় দেখানোর কলাকৌশল নির্ধারণবিষয়ক সেই সভায় উপস্থিত ভূতগুলো দেখতে নাকি ভীষণ ভয়ংকর। সেদিন সেই সাহসী যুবক কোনো রকমে নিজের জান নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এরপর থেকে হোতাপাড়া গ্রামের কেউ আর সেই বাড়িতে ঢোকার সাহস করেনি। এখন ভূতের বাড়ি নামেই এই পোড়াবাড়িটির বিস্তৃত পরিচিতি।

সন্ধ্যার ঠিক পর পোড়াবাড়ির ভেতরে অদ্ভুত সব আওয়াজ হয়। দূর থেকে মনে হয় দলবেঁধে ভূতরা হাসছে। নাচছে। আবার কখনো কখনো মনে হয় দলবেঁধে ভূতরা কাঁদছে। আজ বিটুল সেই ভূতের বাড়িই যাচ্ছে। চৌদ্দ বছর বয়সি হলেও সে ফেলুদার মতো দুরন্ত সাহসী। রহস্যের জট খুলতে পারে। প্রয়োজনে রহস্যের মুখ উন্মোচন করতে সে নেমে যায় দুঃসাহসিক অভিযানে। তার অনেক দিনের ইচ্ছে সে ভূতের মুখোমুখি বসে গল্প করবে। সম্ভব হলে ভূতের সঙ্গে রাতের ডিনারও সারতে চায় সে।

পোড়াবাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বিটুল বিদঘুটে একটা গন্ধ পেয়েছে। মনে হলো আচমকা একটা গন্ধ তার নাকে এসে প্রবল বেগে ধাক্কা দিয়ে গেল। কোনো রকমে সে নাকটা চেপে ধরে আরো ভেতরে ঢুকে গেল। চারদিকে পিনপতন নীরবতা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিটুল তার কাঁধ ব্যাগ থেকে টর্চ লাইট বের করে। লাইট মারতেই মনে হয় তার সামনে একটা কিছু নড়ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। পরক্ষণেই আবার মনে হলো একটা কিছু তার সামনে দিয়ে উড়ে গেল। টর্চ মারতেই ছায়ার মতো কিছু হঠাৎ মিলিয়ে গেল। দক্ষিণ দিকের একটা কক্ষের দিকে ঢুকে গেছে মনে হয়। বিটুল ভাবলো বাদুড় হয়তো! এ রকম পরিত্যক্ত বাড়ি বাদুড়েরা দখলে নিতে বেশি সময় নেয় না। আবারও সে লাইট জ্বেলে দেখে- কোথাও কিছু নেই। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল বিটুল। রুমের সামনে লেখা ‘নাচঘর’। দরজার ওপর ধুলোর আস্তরণ। নাচঘরের ভেতর থেকে ভৌতিক একটা গন্ধ আসছে। বিষয়টা খুব ভালো করেই টের পাচ্ছে বিটুল। মাকড়সার জাল ভেঙে সে দরজা খুলে নাচঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে কোথাও কেউ নাচছে। নূপুরের ঝুমুর ঝুমুর আওয়াজ আসছে কানে। নাচঘরে দিনের বেলাও নাকি কবরের মতো অন্ধকার থাকে। বিটুল কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কোন দিক থেকে আসছে সেই আওয়াজ। না, সে ধরতে পারছে না। এবার বিটুল কিছুটা ভড়কে যায়। দ্রুত সে তার ব্যাগ থেকে একটা শিশি বের করে। শিশিটা ডান হাতের মুঠোয় রাখে। বুকে সাহস নিয়ে আরো সামনের যেতে থাকে। সামনের দিকে সে লাইট ধরতেই অদ্ভুত এক হাসির শব্দ তার কানে ভেসে আসে। বিটুলের উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। মনে হচ্ছে সে সঠিক জায়গায় চলে এসেছে। আজ সে ভূতের সাক্ষাৎ পাবেই। একটু পর সে টের পায় সে সভাঘরে এসে পড়েছে।

হু হু হা হা করে একটা ভূত বিটুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। একচোখা ভূত। বিটুল দেখতে পাচ্ছে না। শুধু ভূতের ভৌতিক হাসিটা শুনতে পাচ্ছে। হাসিটা শুনে তার মনে হচ্ছে- ভূতটা এখানকার দলনেতা। ভূতটা গলা খেঁকিয়ে বলে ওঠে।

- কে রে তুই?

বিটুল অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে সে ভূতটাকে আবিষ্কার করার জন্য চেষ্টা করছে। ভূতটা আবার প্রশ্ন করে?

- কী? আমাকে খুঁজছিস?

- হ্যাঁ। তোর সাহস থাকলে আমার সামনে আয়।

হা হা হু হু করে ভূতটা বলল,

- আমাকে দেখলে তুই তোর পরনের কাপড় নষ্ট করে ফেলবি। জীবনের মায়া থাকলে এখনই দ্রুত পালিয়ে যা।

- না। আমি যাব না। তোর সঙ্গে দেখা না করে আমি যাব না।

- আমাকে একবার দেখলে অজ্ঞান হয়ে তুই মাটিতে পড়ে যাবি। দাঁতের পাটিতে খিল লাগবে। তুই পালা...

- তুই আমার সামনে আয়। দেখি- কে কাকে ভয় পায়?

আচমকা একচোখা একটা ভূত বিটুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওমা কী ভয়ংকর দেখতে! ঠিক কপাল বরাবর একটা বিশাল চোখ তার। তবে নাক নেই। কান দুটো বেশ খাড়া। দাঁতগুলো করাতের মতো ধারালো। ভূতটা আলখাল্লা ধরনের কাপড় পরেছে। কল্পনার চেয়েও ভয়ংকর ও কুৎসিত। ভূতটাকে দেখেই বিটুলের কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে গেছে। তবুও সে সাহস হারায় না। সে তার হাতের শিশির মুখটা খুলে একচোখা ভূতের সামনে ধরতেই ভূতটা নেতিয়ে পড়ে। বিশেষ আতরের মিষ্টি ঘ্রাণে মণ্ডম করছে পুরো পোড়াবাড়ি। সভাঘরে একে একে ঢুকছে তিনচোখা ভূত, মেছোভূত, গেছোভূত, ল্যাংড়া ভূত, পাঁচ হাতের লম্বা ভূত। বিটুলের সামনে হাঁটু গেড়ে সব ভূত বসে আছে। জি, জাঁহাপনা। জি, জাঁহাপনা করছে। বিটুল তার গলায় একটু গাম্ভীর্য ভাব রেখে বলল-

- একচোখা ভূত, তোমার দলের একজনকে বলো আমার জন্য একটা সিংহাসনের ব্যবস্থা করতে।

- জি, জাঁহাপনা।

একচোখা ভূতের হুকুমের আগেই তিনচোখা ভূত একটা সোনার সিংহাসন নিয়ে এলো। হীরার দানার শৈল্পিক কাজ। বিটুল সম্রাট আকবরের মতো সিংহাসন বসেছে। সে ভূতদের মুখে গল্প শুনছে। কারো গল্প শুনে বিটুল হাসতে হাসতে প্রায় অজ্ঞান। আবার কারো গল্প শুনে বিটুলের চোখে জল চলে এসেছে। ভূতরা দেখল বিটুল তাদের সুখের গল্প শুনে হাসছে। আবার তাদের কষ্টের কথা শুনে কাঁদছে। একচোখা ভূত ‘জয় জাঁহাপনা জয়’ বলে চিৎকার করে উঠল। বাকি ভূতও দলপতির সঙ্গে বলল, ‘জয়, জাহাঁপনার জয়।’ খুশিতে টইটম্বুর ভূতরা বিটুলের জন্য মুহূর্তেই রাজকীয় খাবার-দাবারের আয়োজন করে। ভূতদের সঙ্গে বসে সে তৃপ্তি ভরে ডিনার করল। বিটুলের অনেক দিনের ইচ্ছে আজ পূরণ হয়েছে।

আগুন ঝরা ফাগুন ফিরে আসার সময় একচোখা ভূত তাকে এগিয়ে দিতে এলো। পোড়াবাড়ির গেটে এসে দাঁড়াল। বিদায় বেলা একচোখা ভূত বিটুলকে আবার আসার নিমন্ত্রণ করল। সেদিন নাকি বিটুলের সম্মানে ফরেন ভূতদেরও ইনভাইট করব। বিটুল বাড়িতে ফিরে এসে আতরের শিশির মুখটা ভালো করে এঁটে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close