এনাম আনন্দ

  ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

টুনটুনি ও অত্যাচারী রাজা

অচিন দেশের রাজা খুব লোভী ও অত্যাচারী ছিলেন। তার মনে প্রজাদের জন্য কোনো দয়া-মায়া ছিল না। গত বছর বন্যা ও খরার কারণে তেমন কোনো ফসল হয়নি কিন্তু রাজামশাইয়ের খাজনার টাকা চাই-ই চাই। তাই রাজ্যজুড়ে ঘোষণা করে দেওয়া হলো- আগামী রবিবারের মধ্যে অচিন রাজ্যের যত খাজনার টাকা বকেয়া রয়েছে, প্রজারা এসে যেন দিয়ে যান। এই খবর শুনে প্রজারা দিশাহারা হয়ে পড়েন। কোথায় থেকে রাজামশাইকে খাজনার টাকা দেবেন। ফসল তো হয়নি? প্রজারা মিলে রাজামশাইয়ের কাছে খাজনার টাকা মাফ পাওয়ার জন্য রাজদরবারে আসেন। কিন্তু অত্যাচারী রাজা কোনোভাবেই খাজনার টাকা মাফ করবেন না। রাজামশাই পরিষ্কারভাবে প্রজাদের জানিয়ে দেন, খাজনার টাকা দিতেই হবে। যেসব প্রজা খাজনা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন, অমনি তাদের ধরে রাজা জেলে পাঠিয়ে দেন। প্রজারা মনে দুঃখ আর কষ্ট নিয়ে রবিবারের দিন রাজ দরবারে এসে খাজনার টাকা জমা দিয়ে যান আর বলেন, ‘অচিন রাজ্য থাকা দায়/লোভী রাজা খাজনা চায়।’

রাজামশাই খাজনার টাকা পেয়ে খুব আনন্দিত। তাই রানি মাকে রাজামশাই বলেন, আজ আমি খুব খুশি, রাজদরবারে ভোজের আয়োজন করা হোক। রানি বলেন, জো হুকুম জাহাপনা। রাজামশাই ফুলবাগিচায় সোনার চেয়ারে হেলান দিয়ে মনের সুখে গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছেন- ‘সুখের হাওয়া যে বইছে মনে/হরিণ শিকারে যাবো বনে।’

এমন সময় টুনটুনি পাখি লক্ষ করে দেখল যে, রাজামশাই মনের সুখে গান গাচ্ছেন। তাই টুনটুনি দুঃখের গান ধরেছে- ‘মহারাজ করে খাই খাই/রাজ্যজুড়ে শান্তি নাই।’

রাজামশাই টুনটুনির গান কয়েকবার শোনার পর খুব রেগে উঠলেন। উজিরকে হুকুম দিলেন টুনটুনিকে যেন ফুলবাগিচা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজার হুকুম বলে কথা, শেষে তাই করা হলো। এদিকে রাজদরবারে খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাজামশাই রাগে আর মনের ভুলে সোনায় মোড়ানো মোবাইল ফোনটি বাগানেই রেখে যান।

কিছুক্ষণ পর টুনটুনি এসে চকলেটবার মনে করে মোবাইল ফোনটি বাসায় নিয়ে যায়। কারণ মোবাইল ফোনটি দেখতে চকলেটবারের মতোই ছিল। রাতের বেলা রাজামশাই শোয়ার আগে মোবাইল ফোনটি খুঁজে না পেয়ে রানি মাকে জিজ্ঞেস করেন। আমার ফোন কোথায় রেখেছো, দ্রুত দাও, আমি পাতালপুরীর রাজাকে কল দেব। কিন্তু রানি কোথাও ফোন খুঁজে পাচ্ছেন না। রাজামশাই খুব রাগারাগি করলেন। রাজার আচরণে রানি মনে কষ্ট পেয়ে অন্দরমহলের বারান্দায় বসে কান্না করছেন। এমন সময় টুনটুনি এসে গান শুরু করল- ‘শুকনো পাতা ঝরে পরে/টুনটুনি ফোন রিসিভ করে।’

রানি মার বোঝার আর বাকি রইল না যে, টুনটুনি মোবাইল ফোন নিয়েছে। রানি সঙ্গে সঙ্গে রাজামশাইকে এ খবর জানিয়ে দিল। অচিন রাজা সেনাপতি, উজির, নাজির ও সৈন্যদের ডেকে হুকুম দিলেন। টুনটুনির বাসা খুঁজে যা পাওয়া যাবে সব যেন রাজামশাইয়ের কাছে নিয়ে আসে এবং আসার সময় টুনটুনির বাসাটা ভেঙে দিয়ে আসে। সেনাপতি, উজির, নাজির ও সৈন্যরা টুনটুনির বাসা খুঁজে একটি চকলেট মোবাইল ফোন আর চারটি টুনটুনির ছানা পায়। ছানাগুলো টিউটিউ করে ডাকতে ছিল। তারা ছানাগুলো রাজামশাইয়ের হাতে তুলে দিল। রাজামশাই ছানাগুলো হাতে পেয়ে একটি একটি করে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলেন। অত্যাচারী রাজার মনে একটুও মায়া হলো না। মনের দুঃখে টুনটুনি কান্না করছে আর বলছে- ‘টুনি করে আহাজারি/অচিন রাজা অত্যাচারী।’

সারা রাত টুনটুটি কান্না করল। এদিকে রাজা ঘুমের ঘরে স্বপ্ন দেখে- একদল রাক্ষস আর খোক্ষস রাজাকে মাথায় তুলে আছাড় মারছে আর বলছে- ‘যদি জানে বাঁচতে চাও/টুনির কাছে ক্ষমা চাও।’

স্বপ্ন দেখে অচিন রাজার ঘুম ভেঙে যায়। ভয়ে আর ঘুম আসে না। স্বপ্নের কথা রানির কাছে খুলে বললেন। রানি পরামর্শ দিলেন, জাহাঁপনা, আপনি দ্রুত গিয়ে টুনটুনির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। যদি আপনার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? মহারাজ বলেন, ঠিক আছে রানি। কেউ দেখার আগে চলো টুনটুনির কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসি। কিন্তু তাকে কোথায় খুঁজে পাবো? রানি বললেন, মায়ের মায়া-মমতা বলে কথা। নিশ্চয়ই টুনটুনি রাজবাড়িতেই আছে। রাজা আর রানি মিলে টুনটুনিকে খুঁজতে খুঁজতে পেরেশান হয়ে কাঁঠাল তলায় গিয়ে বসলেন। হঠাৎ তারা কাঁঠালগাছের ওপর থেকে কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। টুনটুনি কান্না করছে আর বলছে- ‘রাজা একদিন হবে কানা/মারলো কেন টুনির ছানা।’

রাজামশাই খুব আদবের সঙ্গে টুনটুনিকে ডাকছেন- টুনি ভাই! ও টুনি ভাই! আমি বুঝতে পারছি তোমার মনে অনেক কষ্ট। আমি না বুঝে তোমার ছানাগুলো মেরে ফেলেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও টুনি ভাই! আমি কখনো আর এমন কাজ করব না, আমি কথা দিলাম ভালো হয়ে যাব। তুমি দয়া করে নিচে নেমে এসো। টুনটুনি জবাব দেয়- আমি অত্যাচারী, লোভী জালিম রাজার সঙ্গে কথা বলব না। আমি আগামীকাল সূর্য উদয়ের আগেই এই অত্যাচারী জালিম রাজার রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে চলে যাব। রাজা বলেন, না না, টুনি ভাই! তুমি এমন কাজ করো না। আমার কর্মকা-ে আমি লজ্জিত, তোমার কাছে ক্ষমা চাই, আমাকে ক্ষমা করো। অবশেষে রানি মার অনুরোধে টুনটুনি নিচে নেমে আসে। রাজা বলেন, তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করে দাও, তাহলে আমার রাজ্যের অর্ধেক রাজত্ব তোমার নামে লিখে দেব। তুমি যা চাও তাই দেব। টুনটুনি রাজাকে শর্ত জুড়ে দিয়ে বলে, আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই মহারাজ। তবে প্রজাদের সব খাজনার টাকা ফেরত দিতে হবে। যাদের ঘরে খাবার নেই তাদের রাজ ভাণ্ডার থেকে খাবার দিতে হবে। সব সময় ভালো কাজ করতে হবে। অচিন রাজা টুনটুনির সব শর্ত মেনে নিল। সকালবেলা রাজ্যে ঘোষণা করে দেওয়া হলো। যার যা অভাব আছে, তারা যেন রাজভাণ্ডার থেকে এসে নিয়ে যায়। অচিন রাজ্যজুড়ে আনন্দের সীমা রইল না। রাজামশাইও ভালো হয়ে গেলেন।

টুনটুনির কণ্ঠে আবার নতুন করে গান শুরু হলো- ‘টুনটুনি ভেবে কয়/মহারাজের হোক জয়।’ অতঃপর সবাই মিলে সুখে ও শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close