আবদুস সালাম

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২১

শীতবস্ত্র বিতরণ

চুয়াডাঙ্গা রেল স্টেশনের পাশেই আফরিনদের বাড়ি। ওর দাদার বাড়ি কুষ্টিয়ায়। স্কুল ছুটি থাকলে বাবা ট্রেনে করে ওকে প্রায়ই কুষ্টিয়ায় নিয়ে যান। দু-এক দিন ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন। রেল স্টেশনের পথ ধরেই আফরিনকে স্কুলে যেতে হয়। স্টেশনের আশপাশে অনেক ছিন্নমূল লোকের বসবাস। ওদের দৈনন্দিন জীবনধারণের চিত্র প্রায়ই আফরিনের মতো অনেকেরই চোখে পড়ে। খোলা আকাশের নিচে ওরা তাঁবু টানিয়ে, ছোট ছোট বেড়ার ঘরে ওরা বসবাস করে। শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে ওরা খুব কষ্ট করে। এখন শীতকাল। শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র ওদের নেই বললেই চলে। পুরোনো কাঁথা-কম্বল গায়ে জড়িয়ে কাজকর্ম করে থাকে। তীব্র শীতে কাতর অসহায় মানুষগুলো গায়ে পাটের বস্তা জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে থাকে। সূর্যের আলোই যেন ওদের একমাত্র ভরসা। দূর আকাশে সূর্য উঁকি দিলেই ছোট-বড় অনেকে রৌদ্রস্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কদিন আগে আফরিন দাদাদের বাড়িতে গিয়েছিল। স্টেশনে যাওয়ার পথে সে দেখেছে খড়কুটো ও লাকড়ির জ্বলন্ত অগ্নিকু-ের চারপাশে গোল হয়ে শীতার্ত মানুষগুলো বসে আগুন পোহাচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রায়ই তাপমাত্রা সর্বনিম্নে পৌঁছে যায়। এ সময় মাঝেমধ্যে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। ঘন কুয়াশা ও কনকনে ঠা-ায় কাঁপতে থাকে সাধারণ মানুষ। কোল্ড ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ ঠা-াজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয় নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা। জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। শীতে অনেকেই মৃত্যুবরণ করে। আফরিন দাদাদের বাড়িতে দেখেছে শীতকালে গোলালঘরে গরু-ছাগলগুলোর গায়ে চটের বস্তা জড়ানো থাকে। একই বস্তা সে স্টেশনের আশপাশের গড়ে ওঠা বস্তির লোকদের গায়েও দেখেছে। তাই সে বাবার কাছে জানতে চায়, ওরা চটের বস্তা গায়ে জড়িয়ে থাকে কেন? ‘ওরা গরিব মানুষ। শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য ওদের নেই। তাই চটের বস্তা গায়ে জড়িয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে।’ বাবা উত্তর দেয়। আফরিন তখন উপলব্ধি করে যে, দামি দামি শীতবস্ত্র পরিধান করে বাইরে বের হলেও গায়ে শীত লাগে। তাহলে যারা গরম পোশাক ব্যতীত জীবনযাপন করে, রাস্তায় চলাফেরা করে তাদের তো সীমাহীন অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়। ওইসব গরিব-দুঃখী, অসহায় ও দুস্থ শীতার্ত মানুষদের দুর্দশার কথা ভেবে আফরিনের মনটা কেঁদে ওঠে। সে বস্তিবাসীর জন্য শীতবস্ত্র কিনে দিতে বাবাকে অনুরোধ করে। মেয়ের কথা শুনে বাবা বলেন, ‘সবার জন্য শীতবস্ত্র কিনে দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তবে আমি বেতন পেলে দু-একজনের জন্য শীতবস্ত্র কিনে দেব।’ বাবার কথা শুনে তার মনটা আনন্দে নেচে ওঠে।

আফরিন দেখেছে ওর মা বেশ কিছু পুরোনো জামাকাপড় জোগাড় করে একটা ব্যাগের মধ্যে রেখে দিয়েছে। ও মায়ের কাছে এর কারণ জানতে চায়। মা বলেন, ওগুলো ফেরিওলারা কম দামে কিনতে আসে। তাই যতœ করে রেখে দিয়েছি ওগুলো বিক্রি করব বলে। বলো তো তুমি কেন এসব জানতে চাইছো?

: মা, ওগুলো সস্তায় বিক্রি না করে গরিব-দুঃখী মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দিলে কেমন হয়? এতে তো গরিব মানুষদের অনেক উপকার হবে। রেল স্টেশনের পাশে অনেক শীতার্ত মানুষকে দেখেছি শীতে কষ্ট করতে। ছোট ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ নারী-পুরুষরা পাতলা জামা-কাপড় পরে অনেক কষ্ট করে। তারা শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে। অনেকে সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো শীতজনিত নানা রোগে ভুগে থাকে। আমাদের পুরোনো জামাকাপড়গুলো ওরা পেলে খুব খুশি হবে।

: তুমি তো ঠিকই কথা বলেছো মা। শীতবস্ত্রগুলো ওদের খুব কাজে লাগবে। ওরা উপকৃত হবে। আমি তো ওদের কথা কখনো ভাবিনি। তুমি মনে করিয়ে দিয়ে ভালোই করেছো।

মেয়ে ও মায়ের কথোপকথন শুনে বাবা সামনে এগিয়ে আসেন। বাবা আফরিনের মাকে বলেন, ওর সঙ্গে আমিও একমত। ওগুলো গরিব, দুঃখী ও অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করে দিতে হবে। সামান্য কটা টাকার জন্য পুরোনো জামাকাপড় ফেরিওলাদের কাছে বিক্রি না করাই ভালো হবে। শেষপর্যন্ত আফরিনের কথামতো মা-বাবা পুরোনো জামাকাপড়গুলো গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর মন-মানসিকতা দেখে তারা মেয়ের প্রতি খুব খুশি হলেন। মেয়ের জন্য তারা প্রাণভরে দোয়া করলেন। মা-বাবা রাজি হওয়ায় আফরিনও খুব খুশি হলো। বেতন পাওয়ার পর আফরিনের বাবা বাজার থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ ও শিশুদের জন্য আরো কয়েকটি নতুন শীতবস্ত্র কিনে আনলেন। সময় করে এক দিন সকালে নতুন ও পুরোনো শীতবস্ত্রগুলো নিয়ে বাবা ও মেয়ে রেল স্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা কোনো এক বস্তিঘরের সামনে উপস্থিত হলেন। কয়েকজন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে উলের সোয়েটার, চাদর, জ্যাকেট এবং অন্যান্য জামাকাপড় বিতরণ করে দিলেন। অসহায় দুস্থ মানুষগুলো শীতবস্ত্র পেয়ে যেমন খুশি হলো, তেমনি আফরিন ওদের হাতে শীতবস্ত্রগুলো তুলে দিতে পেরে খুশি হলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close