জিনিয়াস মাহমুদ

  ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

দাদারূপী ভূত

চাঁদের আলোয় গাছের পাতা, পুকুরের জল, রাস্তা-ঘাট, সবুজ ঘাস, ধানখেত কেমন চিকচিক করছে। কয়েকটা বাদুর এগাছ থেকে ওগাছে উড়ে যাচ্ছে। পুকুর পাড়ের জলপাইগাছ থেকে পাখিছানার চিঁচিঁ শব্দ আসছে।

‘দাদা, পাখিছানাটির বোধহয় খিদে পেয়েছে। ওই শুনো কেমন চিঁচিঁ শব্দ করছে। বলল তকি। সে তার দাদার সঙ্গে এশার নামাজ পড়ে এসে মাত্রই বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়েছে।

হতে পারে। বলল দাদা।

দাদা, চলো না আমরা মাঠে যাই। এই চাঁদনি রাতে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে খুব ইচ্ছে করছে। যাবে দাদা? আমরা খুব বেশি দূর যাব না। একটু হেঁটেই চলে আসব। চলো না যাই, দাদা। ও... দাদা। তকির দাদা এ-রাত্রিবেলা মাঠে যেতে প্রথমে রাজি না হলেও পরে তকির জোরাজুরিতে রাজি না হয়ে আর থাকতে পারেননি। একমাত্র নাতি বলে কথা। তাও আবার শহরে থাকে। বাবা-মায়ের সঙ্গে। সেখানেই একটা স্কুলে সেভেন-এ পড়ে সে। গ্রামে খুব একটা আসে না। এখন এসেছে, চার দিন পরেই চলে যাবে। আবার কখন আসে না-আসে কে জানে।

‘তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এখনই আসছি। তোমার দাদিকে বলে আসি। না হলে তোমার দাদি আবার আমাদের জন্য টেবিলে খাবার নিয়ে বসে থাকবে। তবে সাবধান! তুমি এখান থেকে একদম নড়বে না। এই বলে তকির দাদাবাড়ির দিকে পা বাড়ান।

ঠিকাছে দাদা। তুমি যাও। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। বলল তকি।

মিনিট এক পরেই দ্যাখো তো দাদাভাই, আমাকে কেমন লাগছে বলে তার দাদা দুটি হাত কোমরে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আসলে এটা তার দাদা নয়। দাদারূপী ভূত। পরনে ঢিলেঢালা শাদা জামা। গলা থেকে পা পর্যন্ত লম্বা। মাথায় শাদা এক টুকরো কাপড় বাঁধা। মুখ ছাড়া সব শরীর ঢাকা। হাত-পায়ের আঙুলও দেখা যায় না। তকি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকায়। একি! দাদা। তুমি এটা কী পরেছ? এই পোশাক তুমি কোথায় পেলে? তারচে বড় কথা হলো- তুমি না মাত্রই এখান থেকে গেলে! এত তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টালে কী করে?

‘চলো আমরা মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। বলল দাদারূপী ভূতটি।

তারা দুজন মাঠের দিকে হাঁটতে থাকে আর সাত-পাঁচ গল্প করতে থাকে। কিছু দূর গিয়ে তকি খেয়াল করল তার দাদা এখন আর খুব একটা কথাবার্তা বলে না। চুপচাপ কেবল হাঁটছে। তকির বাম-হাত ধরে আছে ভূতটি। দাদা, ও দাদা... তুমি হঠাৎ করে এমন চুপসে গেলে যে! খারাপ লাগছে তোমার? কোনো জবাব নেই। সামনেই একটি উঁচুটিলা। ভূতটি এবার ওই টিলার দিকে হাত ইশারা করে। তকি বুঝে নেয়, তারা সেখানে যাবে। দাদা সেখানে গিয়েই বোধহয় তার সঙ্গে কথা বলবে। তাই সে বলে, ওইযে একটা উঁচুটিলা দেখা যাচ্ছে, আমরা কি সেখানে যাব? আর তুমি সেখানে গিয়ে পরে কথা বলবে, দাদা? ভূতটি মাথা নাড়ে।

একটু পরে তকি আবার বলে- আচ্ছা দাদা, তুমি কি কখনো ভূত দেখেছ? ভূতেরা নাকি দেখতে খুব অদ্ভুত চেহেরার হয়! চোখের পলকেই নাকি রূপ পাল্টাতে পারে। তারা নাকি যখন হাঁটে তখন মাটিতে তাদের পা পড়ে না। আর নাকি সব সময় তারা শাদা পোশাক পরতে খুব পছন্দ করে। ঠিক তোমার গায়ের কোর্তার মতো! এই বলে তকি হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে।

তকির কথা শুনে চোখ-রাঙিয়ে তার দিকে তাকায় দাদারূপী ভূতটি। হঠাৎ করে দাদা এমন চোখ বড় বড় করে তাকাল কেন? তকি তা বুঝতে পারে না। সে বুঝতে না পারলেও এই ভাবনাটা তার মাথায় কিছুক্ষণ ঘুরপাক খায়। এবার তকি আর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ হাঁটতে থাকে। একসময় তারা টিলার কাছে চলে যায়। তারপর ভূতটি তকিকে তার পিঠে চড়িয়ে তাকে নিয়ে টিলায় ওঠে। যা দেখে তকি কিছুটা অবাক হয়। পরে টিলায় উঠে যখন সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় ভূতটি বলে, এখানে এসে তোমার কেমন লাগছে তকি? তকি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলে, জায়গাটা খুব সুন্দর। একটু একটু ঠান্ডা বাতাসও বইছে। আমার খুব ভালো লাগছে। দাদা, ওই দ্যাখো, চাঁদের আলোয় আমাদের বাড়ির নারকেল গাছটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাই না? তকির কথা শুনে ভূতটি মাথা নাড়ে। তকি আবারও বলে, দাদা, একটা গল্প শোনাও না। এখন আমার গল্প শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

তুমি কোন ধরনের গল্প শুনতে চাও, তকি? ভূতটি তকির কাছে জানতে চাইল।

ভৌতিকগল্প। বলল তকি।

তাহলে শুনো। এই বলে ভূতটি বলতে থাকে, এক চাঁদনি রাতে একটি ছেলে তার দাদাকে বলল, সে তার দাদার সঙ্গে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে চায়। তার দাদা প্রথমে রাজি না হলেও পরে রাজি হয়। তারপর দাদা তাকে পুকুরপাড়ে দাঁড়াতে বলে বাড়ির ভেতরে যায় সেই ছেলের দাদির কাছে বলতে যে, তারা মাঠে হাঁটতে যাচ্ছে। তখন পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি ভূত। সে যেই না দেখল সেই ছেলেটির দাদা তাকে পুকুরপাড়ে একা রেখে বাড়িতে চলে গেছে অমনি সে তার দাদার রূপ ধরে ছেলেটিকে নিয়ে মাঠের দিকে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় তারা একটি উঁচুটিলায় এসে দাঁড়ায়। ছেলেটি তার দাদারূপী সেই ভূতটির কাছে গল্প শুনতে বায়না ধরে। ভৌতিকগল্প। পরে ভূতটি তাকে গল্প শোনাতে থাকে। এই বলে ভূতটি একটু থেমে তকির চোখে চোখ রেখে আবারও বলে, সেই ছেলেটির নাম কি জানো? তার নাম হলো তকি। যে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই ভূতটি হলাম আমি। হি-হি-হি.... হি-হি-হি.....। এক অদ্ভুত নাকি সুরে হাসতে থাকে ভূতটি।

ভূতের কথা শুনে তকি ভয়ে একটু পিছিয়ে পড়ে। পরক্ষণেই সে ঘামতে শুরু করে। মুখে কোনো কথা নেই। হাত-পা কাঁপছে। কান্না-কান্না একটা ভাব চলে আসে তার। তাহলে কি সত্যি সত্যি এটা ভূত! দাদা নয়? সে ভাবল।

তকির নীরবতা আর পিছিয়ে যাওয়া দেখে ভূতটি এবার বলে, কি! ভয় পাচ্ছ, তকি? ভয় পেলেও কোনো লাভ নেই। তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। আজ পূর্ণিমা রাত। কত দিন ধরে আমি মানুষের রক্ত খাই না। আজ তোমাকে পেয়েছি। এখন আমি তোমার রক্ত খাব। কী মজা! এই বলে ভূতটি হি-হি-হি করে হাসতে হাসতে তকির দিকে পা বাড়ায়।

তকি এখন কী করবে আর কী করবে না, তা যেন সে ভেবেই পাচ্ছে না। কখনো ভাবছে, এটা তার দাদাই, তার সঙ্গে মজা করছে। আবার ভাবে, যদি এটা তার দাদাই হবে, তাহলে এমনভাবে তাকে ভয় দেখাবে কেন? দাদা তো কখনোই তাকে ভয় দেখিয়ে কথা বলে না। আচ্ছা, দেখি এটা দাদা নাকি সত্যি সত্যি ভূত। এই ভেবে সে নাকিসুরে ফিকফিক করে হেসে ওঠে। তকির হাসি দেখে ভূতটি বলে, কিরে! তুই হাসছিস যে! আমাকে দেখে মানুষেরা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। আর তুই হাসছিস! তোর কি ভয়টয় কিচ্ছু নেই নাকি? অ্যা। তকি ভূতের কথা শুনে আরো জোরে জোরে হাসতে থাকে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলে, আমি ভূতের গল্প শুনতে পছন্দ করলেও এসব ভূতটুত বিশ্বাস করি না। ভূত বলতে কিছু আছে নাকি! তাছাড়া তুমি যে ভূত, তার প্রমাণ কী? তুমি বললে, তুমি ভূত আর আমি তাতেই বিশ্বাস করে ফেলব? এত বোকা আমি নই। তুমি যে আসলেই একটি ভূত, তার প্রমাণ যদি তুমি দেখাতে পার, তবেই আমি বিশ্বাস করব, তুমি ভূত। তকির কথা শুনে ভূতটি আবারও হি-হি-হি করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, ও, এই কথা? তাহলে দ্যাখ। বলেই দাদারূপী সেই ভূতটি চোখের পলকে তকির বয়সি একটি ছেলের রূপ নেয়। পরে আবার আগের রূপে ফিরে আসে। যা দেখে তকি চমকে যায়। এবার তার আর বুঝতে বাকি নেই যে, এটা তার দাদা নয়। এটা ভূতই। এখন সে ভাবতে থাকে, কীভাবে এই ভূতটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে হঠাৎই তার মনে পড়ে যায় গত জুমার দিনের কথা। হুজুর বলেছিলেন, ভূতরা আজানের শব্দ শুনলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এবার তকি আর দেরি না করে পশ্চিম দিক ফিরে দাঁড়িয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে উচ্চশব্দে আজান দিতে শুরু করে। আর আজানের সুর ভূতের কানে আসতেই ভূতটি সজোরে এক চিৎকার দিয়ে দৌড় দিতে দিতে হাওয়ার সঙ্গে মিশে যায়। অন্যদিকে তকির দাদা-দাদি তাকে এদিক-সেদিক খুঁজে না পেয়ে যখন তারা মাঠের দিকে আসেন; তখন তকির কণ্ঠে আজানের আওয়াজ শুনতে পান। পরে আজানের আওয়াজ যেদিক থেকে আসছে, সেদিকেই তারা হাঁটতে থাকেন। খানিকটা পরেই দাদা-দাদি তকির কাছে গিয়ে পৌঁছান। তখনো তকি আজান দিচ্ছে। আজান দেওয়া শেষ হলে সে ধীরে ধীরে চোখ খোলে। তারপর ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়েই চমকে ওঠে। একী! আজান দিলে না ভূতরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। এখন দেখি এক ভূত আরেক ভূতেরে ডেকে এনেছে! হুজুর কি তাহলে মিথ্যে কথা বলেছিল! ভাবল তকি।

এবার সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার দাদা বলে উঠেন, তকি! দাদাভাই আমার। তুমি এখানে কী করছ? তোমাকে আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। দাদি বলেন, দাদুভাই! কথা বলছ না কেন? আর তুমি এখানে ক্যামনে এলে! তকি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, তোমরা কি সত্যিই আমার দাদা-দাদি? নাকি ভূ-ভূত! তকির মুখে ভূতের কথা শুনে দাদা-দাদি দুজনেই তাকে জড়িয়ে ধরে। দাদি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, এসব তুমি কী বলছ দাদুভাই! আমরা ভূত হতে যাব কেন? আমরা তোমার দাদা-দাদি। তকির দাদা এবার বুঝে নেন, তকি নিশ্চয় ভূতের পাল্লায় পড়ে এখানে এসেছে। পরে তারা তকিকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন। বাড়িতে গিয়ে তকি তার দাদা-দাদিকে সব কিছু খুলে বলে। তকির কথা শুনে দাদা তকির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে তার দাদিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখন তকির বয়সইবা আর কত হবে। মাত্র তো ও সেভেন-এ পড়ছে। এই বয়সে সে এমন একটা বিপদ থেকে আজ সাহস করে বুদ্ধি খাটিয়ে যেভাবে নিজেকে রক্ষা করেছে, সত্যিই তা অবাক করার মতো। তকির দাদি মাথা নেড়ে হ্যা বলেন। পরে দাদা-দাদি দুজনেই তকির মাথায় হাত দিয়ে তাকে দোয়া করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close