গোলাম কিবরিয়া

  ২২ মার্চ, ২০২২

মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলা

যুদ্ধে জয় এসেছে অথচ তাতে নারীর অবদান নেই, বিশ্ব ইতিহাসে তা বিরল। ব্যতিক্রম ছিল না বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও। নারী সমরে ছিল, ছিল নেপথ্যের শক্তি-সাহসে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ঈর্ষণীয়, যা যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে। একটি পতাকার জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা সম্মিলিতভাবে লড়েছিল ১৯৭১ সালে এবং দেশকে মুক্ত করেছিল। আদায় করেছিল স্বাধীনতা। গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে নারী।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব থেকেই নারীর অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত অদম্য সাহস আর উদ্দীপনা নিয়ে তারা বিজয় অর্জন করে আসেন। বিশেষ করে যুদ্ধে গেরিলা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা সংগ্রামী নারী সমাজে আজও প্রেরণার উৎস।

বিজয়ের মাসের প্রথম প্রহরেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত তারামন বিবি। উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে তারামন বিবির যুদ্ধজয়ের গল্পগাথা আজও শিহরিত করে মুক্তিকামী মানুষের। স্বাধীনতাযুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। যেমন- কাঁকন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বেগম ফোরকানের কথা; যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম দলে ছিলেন আটজন। তারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে শতাধিক নারীকে নির্বাচিত করা হয়। প্রথমে তাদের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয় এবং তাদের মধ্যে সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

নারী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আশালতা বৈদ্য। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুদ্ধে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দেন ৪৫ জনের সশস্ত্র নারী গেরিলা দলকে। ৩৫০ নারীকে নিয়ে গঠিত একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নেতৃত্বেও ছিলেন এই সাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঘরে বসে থাকতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯নং সেক্টরে কোটালীপাড়া সীমানা সাব-সেক্টর কমান্ডার হেমায়েত বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। হেমায়েত বাহিনীতে মহিলা বাহিনী নামে আলাদা একটি বাহিনী গঠন করা হয়। এ মহিলা বাহিনীতে মোট ৩৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এই বিশাল নারী মুক্তিযোদ্ধার বাহিনীর একমাত্র কমান্ডার ছিলেন আশালতা বৈদ্য। পূর্বাঞ্চলীয় হাইকমান্ড শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আ স ম আবদুর রব কিশোর-তরুণ নেত্রীদের গেরিলা ও সুইসাইড স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন লেম্বুচোরা ক্যাম্প, আগরতলায়। মুক্তিযুদ্ধের আরেক মহীয়সী নারী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সংগ্রামী যোদ্ধা নারীদের জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’ চালু হয়েছিল। সেই ক্যাম্পে নারীরা অস্ত্র চালনা শিখতেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুণী ও কিশোরী সংগঠক গোবরা ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। ‘গোবরা ক্যাম্প’-এ মেয়েদের দেওয়া হতো তিন ধরনের ট্রেনিং- ১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। জানা যায়, নারী যোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ আরো তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে।

মুক্তিযুদ্ধে নারী শক্তির অন্যতম নাম তারামন বিবি বীরপ্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাঁধুনি হিসেবে যোগ দেন। রাজীবপুর ওয়ার ফিল্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করেন এ গেরিলা। একের পর এক অ্যাসাইনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠি ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন। রাতের বেলা পাকিস্তানি সেনাশিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাঁড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকিস্তানি সেনাশিবিরে হামলা চালায়। এ ছাড়া ওই রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরুর আগে তারামন বিবি অসংখ্য বাঙালি পরিবারকে পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে নিরাপদ স্থানে আনার অ্যাসাইনমেন্টেও অংশ নেয়। একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধশিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। একসময় পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলেছিল ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। সাত-আট দিন অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।

বরিশালের মুলাদী উপজেলার কুতুব বাহিনীতে করুনা বেগম অন্য মহিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এ বাহিনীর অধীনে ৫০ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ছদ্মবেশে শত্রু ছাউনির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছেন। এ ছাড়া স্টেনগান, রাইফেল চালানো এবং যেকোনো ধরনের বিস্ফোরকদ্রব্য সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাইফেল, বন্দুক, এসএমজি, এসএলআর সবকিছু চালানোতেই সমান পারদর্শী ছিলেন আলেয়া। শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান বুঝে তাদের মোকাবিলা করার জন্য এসব সমরাস্ত্র হাতে নিয়ে ছুটতেন তিনি। একাধিক সম্মুখযুদ্ধে তার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি ভারতের চাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যুদ্ধ কৌশল ও সমরাস্ত্র চালানো শেখেন।

পিরোজপুর জেলার অপারেশন স্বরূপকাঠি বাহিনীর অকুতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কণা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোট। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপানায় মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। পিরোজপুরে অখ্যাত গ্রামের নারীরা হয়ে উঠেছিলেন একেকজন দুর্ধর্ষ গেরিলা। বীথিকা গেরিলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং দেওয়ার জন্য নারীদের সংগ্রহ করে আনতেন। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ নারীকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল।

রণাঙ্গনে দাঁড়িয়েও বিপুল বিক্রমে লড়েছেন নারীরা। তবু আফসোসের সঙ্গে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়নি। বিশ্লেষক এবং ইতিহাসবিদদের মতে, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান এখনো পরিপূর্ণভাবে মূল্যায়ন হয়নি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে শত শত নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি এবং গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিলেও এ পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছেন কম নারীই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close