সিয়াম মাহমুদ
বাগান করে স্বাবলম্বী কলেজশিক্ষার্থী মরিয়ম
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যেখানে স্নাতক শেষ করতেই পার করে দেন কয়েক বছর, সেখানে স্বাবলম্বী হওয়া তো অকল্পনীয়। কিন্তু ব্যতিক্রম উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন মরিয়ম। পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি শখের বশে করেন বাগান। আর সেই বাগানই তাকে করেছে স্বাবলম্বী। ইতিমধ্যে শখের বাগানের মাধ্যমে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে।
মরিয়ম নাহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি তিতুমীর কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার মাজুর গ্রামের মিজানুর রহমান মেয়ে। তিনি কুমিল্লা জেলা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পরিবারের সঙ্গে মাজুর গ্রামেই থাকেন তিনি।
করোনাকালে মানুষ যখন গৃহবন্দি, মরিয়ম তখন মাত্র ৩৫০ টাকা দিয়ে ছোট্ট পরিসরে ছাদে ও বাড়ির আঙিনায় ফুল বাগান তৈরি করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজেই খরচেই চালাচ্ছিলেন পড়াশোনা, পাশাপাশি পরিবারকেও সহযোগিতা করতেন। কিন্তু গত ছয় মাস আগে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার সব দায়িত্ব তার কাঁধে চলে আসে।
মরিয়ম বলেন, করোনার সময় হাতে কোনো কাজ ছিল না। বাড়িতে বসেই থাকতাম। ফেসবুক চালাতে চালাতে হঠাৎ ফুল বাগান করার চিন্তা মাথায় আসে। আর আমি ফুল খুবই পছন্দ করি। এজন্য ৩৫০-৪০০ টাকার মতো খরচ করে ওই সময় ছাদে ও বাড়ির আঙিনায় ফুলগাছ লাগাই।
প্রথম দিকে শুরুটা হয়েছিল খুবই সাধারণ কিছু ফুল দিয়ে। এ কাজে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন বাবা মিজানুর রহমান। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের নানা বাধা থাকলেও মেয়ের স্বপ্নকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘Marium's Garden’ নামে একটি পেজও রয়েছে তার।
মরিয়ম বলেন, প্রথমে তো কেউ সাপোর্ট করেননি। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে বাগান করা নিয়ে হেয় করতেন। তবে বাবা-মা আমার পাশে সব সময় ছিলেন। বিশেষ করে আমার বাবা আমাকে অনেক সাহায্য করতেন। আমার বাবাই আমাকে বড় বাগানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। হঠাৎ করে বাবা চলে যাওয়াতে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। এ বছর ছোট পরিসরে আবারও শুরু করেছি বাগান।
২০২২ সালে বাড়ির ছাদ ও আঙিনার পাশাপশি মাঠে নিজেদের ৩ শতাংশ জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। পরে ২০২৩ সালের মার্চের দিকে বাবার উৎসাহে সেটা বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ জমিতে তৈরি করেন বাগান। ফুল ছাড়াও লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শিম, বেগুন, কাঁচা মরিচ, মিষ্টি আলু, লাল শাকসহ বিভিন্ন শাকসবজির চাষও করেন।
বর্তমানে তার বাগানে ৬০টি ভিন্ন রঙের পর্তুলিকা, ২০টিরও বেশি রঙের লিলি, স্যাকুলেন্ট, কাটামুকুট, সিডাম, নানৌক, গ্রিনলিফ, জেব্রিনা, বেলি, জলগোলাপ, বুতামসহ প্রায় ১৫০ প্রজাতির ফুল রয়েছে।
ফুলের পাশাপাশি শাকসবজির চাষ কীভাবে করেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শীতকালে ফুলগাছ কমে যায়। ওই সময়ই মূলত শাকসবজির চাষ করি। আবার কিছু সবজির আছে, যেগুলো বাঁশের মাচায় চাষ করা যায়। যেসব সবজি মাচায় চাষ করা যায়, আমি সেগুলো বেশি করি। আমি জানি কোন ফুলগাছের জন্য কখন বেশি জায়গা লাগে। সব মিলিয়ে কোনো কিছুতেই প্রভাব পড়ে না।
তিনি মূলত ফুলের গাছ, কলম, ডাল ও স্যাকুলেন্টের পাতা বিক্রি করেন। কিন্তু ফুল বিক্রি করেন না। শীতের সময় ফুলগাছ কমে যায়। ফলে তখন প্রতি মাসে ৩-৪ হাজার টাকা আয় হয়। তবে অন্য সময় প্রতি মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করেন ফুল বাগান থেকে। শীতে তার ফুল বাগানের আয় কমে গেলেও সমস্যা হয় না, কারণ ওইসময় তিনি নানা ধরনের প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি চাষ করেন। এতে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের চাহিদাও মেটাতে পারেন তিনি।
সম্প্রতি তিনি নারকেল তেল তৈরি করে খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গে সেগুলো গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। সাড়াও পাচ্ছেন বেশ।
গত মাসেই বিয়ে হয়েছে মরিয়মের, শ্বশুরবাড়ি ঢাকায়। তার এই উদ্যোক্তার যাত্রায় কোনো বাধা আসবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে সবকিছু জানিয়েই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। আর আমার বাবা নেই, বাড়িতে ছোট ভাই, মা ও আমি থাকি। এ জন্য শুধু বিয়ে পড়িয়ে রাখা হয়েছে। পরে ওঠানো হবে। সবকিছু জেনেই যখন এ বিয়ে হয়েছে, কোনো সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ। আর আমি আমার স্বপ্নে অটল।
মরিয়ম বলেন, আজ আমি একজন সফল উদ্যোক্তা। তা ছাড়া আমার বাাগান ব্যবসার সফলতার কারণে গ্রামেও বেশ পরিচিত হয়েছি। এলাকায় সবাই আমাকে চেনে। এখান থেকে পেছানোর সুযোগ নেই।
এই সফল উদ্যোক্তা বলেন, কুমিল্লার ছোট্ট একটি গ্রামে বাড়ি আমাদের। বাগান করার স্বপ্ন দেখতাম ছোট থেকেই। এখন তা পূর্ণ হয়েছে। চেষ্টা আর ইচ্ছে থাকলে, মানুষ সবকিছু করতে পারে। আমার মতো আরো অনেক মেয়ে আছেন, যাদের শখ বাগান করা। আমি চাই, তারা বাগান করে শখ পূর্ণ করার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হোক। প্রয়োজন হলে তাদের সহযোগিতা করার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
"