প্রতীক ইজাজ

  ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সু চির ভাষণ নিয়ে দেশের বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া

আশা-নিরাশা দুটোই আছে

অবশেষে মুখ খুললেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞের তিন সপ্তাহের মাথায় গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন তিনি। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার মধ্যে তার ভাষণ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। ফলে সু চির ভাষণ ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের ভেতর থেকেও।

যদিও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সু চির ভাষণে আশ্বস্ত হতে পারছে না। তারা বলছে, সু চি তার ভাষণে সেনাবাহিনীর ভূমিকার বিষয়ে কিছু বলেননি। উল্টো বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আক্রান্ত লোকজনকে দোষারোপ করেছেন। কিন্তু দেশের কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষকরা রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও বাংলাদেশের শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সু চির ভাষণে আশা ও নিরাশা দুটোই দেখছেন।

দেশের বিশ্লেষকরা একদিকে বলছেন, সু চি তার ভাষণের মধ্য দিয়ে পক্ষান্তরে সে দেশের সামরিক বাহিনীর নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। এ ভাষণ মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের একটি কৌশলমাত্র। পাশাপাশি এই ভাষণের মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানে টানেলের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছেন বলেও মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সু চি তার ভাষণে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্কের কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানের একটি পথ তৈরি হলো। এখন বাংলাদেশের উচিত কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মধ্য দিয়ে সংকট সমাধানের পথে যাওয়া।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও শরণার্থী গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, সু চি তার ভাষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। উনি বলেছেন, মিয়ানমারে কোনো জাতিগত নিধন ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। অথচ সেখান থেকে প্রাণ বাঁচাতে চার লাখের বেশি মানুষ শুধু এক কাপড়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। জন্মভূমি মানুষের মনোজগতের বিষয়। কখন মানুষ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে পালায়? যখন একেবারেই নিরুপায় হয়।

সু চির ভাষণে স্ববিরোধীতাও রয়েছে উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, একদিকে নিধনের কথা অস্বীকার করছেন, আবার বলছেন ফেরত নেবেন। এটি স্ববিরোধী বক্তব্য। তার মানে সু চির প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ, সেটিকে প্রশমন করতে চেয়েছেন। কিন্তু এই ভাষণের ফলে তার প্রতি মানুষের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হলেন তিনি। আশ্বস্ত হতাম, তিনি যদি বলতেন, কারা এমন নিধনযজ্ঞ চালাল, কেন মানুষ চলে এলো, তা হলে বোঝা যেত, তিনি সমাধান চান। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চান।

রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সু চি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি কথার কথা। জাকির হোসেনের মতে, এই মুহূর্তে কোনো রোহিঙ্গার কাছেই নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ নেই। সর্বশেষ ভোট দেওয়ার জন্য ১৯৯৬ সালে গুটিকয় রোহিঙ্গাকে (১৩ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মাত্র আট-নয় হাজার কার্ড) যে সাদা কার্ড দেওয়া হয়, নির্বাচনের পর সেটিও বাতিল করা হয়েছে। ফলে সাংবিধানিকভাবে তাদের নাগরিক হিসেবেই রাখা হয়নি।

সু চি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত জাতিগত নিধনের প্রমাণাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সে দেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যাওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, গণহত্যার কোনো প্রমাণই রাখেনি। ফলে তদন্ত করার সুযোগ দিতে হবে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচার করার কথা বলতে হবে।

‘বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার প্রসঙ্গে সু চি কোনো আশার কিছু বলেননি। ’৯২ সালে যে চুক্তি হয়েছিল, সে অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নেয়নি। ফেরত নেওয়ার প্রসঙ্গ তখনই আসত, যদি নিধনযজ্ঞ ও পালিয়ে আসার কথা স্বীকার করতেন’-বলেন এই গবেষক। তিনি বলেন, মূলত এই ভাষণ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত প্রশমনের একটি কৌশলমাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক বলেন, সু চির বক্তব্য আশাব্যঞ্জক কিছু নয়। তার ভাষণ এমনই হওয়ার কথা ছিল। এর বেশি কিছু আশাও ছিল না কারো। বিশেষ করে তার এই ভাষণকে দুই শক্তি চীন ও রাশিয়া যেভাবে প্রশংসা করেছে, সেটি আরো বেশি হতাশাজনক। তার মানে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান প্রলম্বিত হবে।

‘তবে সু চির ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট হলো’-উল্লেখ করে এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, মিয়ানমার সরকারের মতো সু চিও রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞের কথা অস্বীকার করলো। অর্থাৎ বিশ্ব ও মিয়ানমার যে মুখোমুখি, তা স্পষ্ট হলো। সু চি তার ভাষণের মধ্য দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। অবশ্য যাচাই-বাছাই করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা যে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে বোঝা গেল মিয়ানমারের কিছুটা হলেও উপলব্ধি হয়েছে।

অবশ্য মিয়ানমারের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম সু চির ভাষণের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে টানেলের শেষে কিছুটা হলেও আলো দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বলেন, সু চি তার ভাষণে দুই দেশের মধ্যে (মিয়ানমার ও বাংলাদেশ) উষ্ণ সম্পর্কের কথা বলেছেন। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছেন। সুতরাং এই ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে ভালো কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে যেতে হবে। ফলে এই ভাষণে আশাও আছে, নিরাশাও আছে।

এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, আমরাও চাই মিয়ানমারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হোক। বাণিজ্যিক ও ভৌগোলিক কারণেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক দরকার। আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তাদের থেকে কোনো বাণিজ্যিক সুবিধা নিতে পারছি না। অথচ রাশিয়া, চিন, ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্র ঠিকই সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তার মানে এত দিন আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কে গুরুত্ব দিইনি। আজ যদি ভালো সম্পর্ক থাকত, তা হলে অন্য দেশের দ্বারস্থ হওয়া লাগত না। আমরা নিজেরাই সংকট সমাধান করতে পারতাম। মিয়ানমার আমাদের চেয়ে পাঁচ গুণ বড় দেশ। জনসংখ্যা দুই ভাগের এক ভাগ। নানা ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং ভালো সম্পর্ক করতে হবে। মেধাবী কূটনীতিককে সেখানে দায়িত্ব দিতে হবে। যেমন ভারত দিয়েছে। তাদের ধান চাল আছে।

তবে এই সাবেক কূটনীতিক এ কথাও বলেছেন, মিয়ানমার সেনাপ্রধান রোহিঙ্গা ইস্যুতে সে দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, সু চি তার ভাষণের মধ্য দিয়ে সে আহ্বানে সাড়া দিলেন। উনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে অপরাগ হলেন। মিথ্যাচার করলেন। যদিও সু চি বলছেন, ১৯৯২ সালের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবেন। কিন্তু সেই চুক্তির পর এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকেই ফেরত নেওয়া হয়নি। বলছেন, কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন করবে। সেটিও কীভাবে করবেন, সেটাই প্রশ্ন। কারণ সে কমিশনের মূল বিষয়ই হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist