মিজান রহমান

  ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

উপজেলা নির্বাচন

তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা আওয়ামী লীগে

সব ধরনের প্রভাবমুক্ত রেখে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও ভোটার অংশগ্রহণমূলক করতে জিরো টলারেন্স নীতিতে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমপি-মন্ত্রী এবং স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা যাতে কোনোভাবেই এ নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সেজন্য অবশেষে হার্ডলাইনে হাঁটছে দলটি। সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কেউ কোনো ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মূলত আওয়ামী লীগের এ বক্তব্যে উঠে এসেছে এবারের উপজেলা নির্বাচন ভোটার অংশগ্রহণমূলক করতে দলটি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এ কৌশলের কারণে ভোটের অনেক আগেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও লড়াই হতে যাচ্ছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতাদের নিজেদের মধ্যে। প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলটির গড়ে তিনজন করে প্রার্থী হচ্ছেন। গত সোমবার ছিল প্রথম ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন। ১৫০টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৬৯৬ জন। ১৪১টি উপজেলায় দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তত ৪৬৬ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতা আছেন কমবেশি ৪৫ জন। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর জামায়াতে ইসলামীর অন্তত ২২ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় সারা দেশে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখনো আইনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান আছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও নেই। তাদের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করতে আওয়ামী লীগ এবার উপজেলায় দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দিচ্ছে না। দলটির নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের উপজেলা নির্বাচন এমনভাবে করতে চায় দলটির, যা দেশের নির্বাচনের ইতিহাস পাল্টে দেবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে উদাহর সৃষ্টি করতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। এজন্য এবারের উপজেলা নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকেই নৌকা প্রতীক দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। উৎসাহিত করা হচ্ছে ব্যাপক প্রার্থী যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এতে নির্বাচন যথেষ্ট অংশগ্রহণমূলক হবে বলে প্রত্যাশা দলেল নেতাদের। নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করার বিষয়ে জিরো টলারেন্সে রয়েছে দলরটি। এজন্য বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী-এমপিদের নিজের লোককে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি করানো বা ‘মাই ম্যান’ কালচার ভেঙে দিতে দলের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ঈদের দিন শুভেচ্ছা বিনিময় করে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা এবং বিভিন্ন মহলকে এ-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উপজেলা নির্বাচনে কোনো কারচুপি করা হবে না। দলীয় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা হবে না, মন্ত্রী-এমপিরা এবং আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের নিজের প্রার্থীকে যদি জিতিয়ে আনার জন্য কোনোরকম অবৈধ উপায় অবলম্বন করেন বা কারচুপি করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এরই মধ্যে মন্ত্রী-এমপিদের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে যেন তারা কোনো প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে কাজ না করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মন্ত্রী-এমপিরা এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে তাদের নিজস্ব পছন্দের ব্যক্তি বা মাই ম্যানদের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এর ফলে উপজেলাগুলোয় এক ধরনের কোন্দল এবং বিভক্তি তীব্র আকার ধারণ করেছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা যে যার মতো করে পারছে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি নতুন সংকট তৈরি করেছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি অবশ্য এটিকে সংকট মনে করছেন না, বরং তিনি এটি জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটি মাধ্যম হিসেবে মনে করছেন। উপজেলা নির্বাচনে যাই ফল হোক না কেন, তা মেনে নেওয়া হবে। কোথাও প্রভাব বিস্তার করা হবে না। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছেন, প্রধানমন্ত্রী উপজেলা নির্বাচনকে একটি মডেল নির্বাচন করতে চান। দলীয় সরকারের অধীনে যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে এবং জনগণ যেন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারে, তার সুস্পষ্ট একটি প্রমাণ রাখতে চায় আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে। এ কারণেই নির্বাচনে কোনোরকম কারচুপি বা অনিয়ম বরদাশত করা হবে না বলে আওয়ামী লীগ সভাপতির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের ভেতর যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে, সেই কোন্দলের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক প্রার্থী থাকতে পারে এবং এটি নিয়ে সহিংসতাও হতে পারে। তবে একাধিক প্রার্থী থাকার একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। এতে নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ বাড়বে। আওয়ামী লীগ সেটিই চাচ্ছে। ভোটারদের অংশগ্রহণের ফলে উপজেলা নির্বাচন একটি উৎসবমুখর পরিবেশে হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী থাকলেও এ নির্বাচনে যিনি জনপ্রিয় তিনিই জয়যুক্ত হবেন। কারণ জনগণ সবকিছু বিচার বিবেচনা করেই ভোট দেবেন। আর আওয়ামী লীগের নিজস্ব প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং আওয়ামী লীগ দেখাতে চাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

নির্বাচনে কোনো ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিনষ্ট করার কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকার জন্য মন্ত্রীসহ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি ও নেতাকর্মীদের প্রতি সাংগঠনিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। উপজেলা নির্বাচনে কোনোরকম হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের মতামতের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটবে এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে নিজেদের ভোট দেবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত প্রশাসনও শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। কেউ কোনো ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close