নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২১ মার্চ, ২০২৪

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাত বছরের পরিকল্পনা

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততায় ঘাটতির কারণে দিন দিন খারাপ হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বাড়ছে সংক্রমণের হার, তীব্রতা আর জটিলতা। হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক ও নার্সের অপ্রতুলতার কারণে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে গিয়ে ব্যাহত হচ্ছে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করতে জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল (২০২৪-৩০) নিয়েছে সরকার। গেল বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপের পর এ উদ্যোগ নিল সরকার।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ পরিকল্পনাটি গত মঙ্গলবার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার লক্ষ্য-২০৩০ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ও এ রোগে মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য মতে, গত বছর ৩ লাখ ২১ হাজার জনেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষ। সে হিসাবে মৃত্যুর হার ০.৫৩ শতাংশ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সাত বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনা হবে। প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ একজন আক্রান্ত হবে। আর এ রোগে মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনা হবে ০.১ শতাংশে। অর্থাৎ প্রতি এক হাজার রোগীর মধ্যে সর্বোচ্চ একজনের মৃত্যু।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন এই কৌশলপত্রে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, ডেঙ্গু ভাইরাস তার ধরন পরিবর্তন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল নেওয়া হচ্ছে। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, অধিক জলাবদ্ধতা, বন্যা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও দেশের ঋতুতে অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণে ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়াসহ ডেঙ্গুর অন্যান্য ভেক্টরবাহিত রোগের সংক্রমণের জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু পরিস্থিতি আরো অনুকূল হয়ে উঠছে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ বর্ষাকালে শীর্ষে থাকে। মশার ঘনত্ব এবং বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গুর সংক্রমণের হার।

এতে আরো বলা হয়েছে, ডেঙ্গুর জন্য কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে সময়মতো রোগ শনাক্ত করা, গুরুতর ডেঙ্গু সংক্রমণের সতর্কতা চিহ্ন চিহ্নিত করা এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা হলো মৃত্যুহার এক শতাংশের কম করার মূল উপাদান।

যেভাবে বাস্তবায়ন হবে এই কৌশল : এই কৌশল বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করা হবে। চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বাড়ানো হবে, যাতে দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।

একইসঙ্গে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা, যাতে কীটনাশক ও অন্যান্য পদ্ধতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায়।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে গৃহস্থালি পর্যায়ে কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে মাল্টিসেক্টরাল কো-অর্ডিশেন ব্যবস্থা করা হবে।

ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেওয়াও এই কৌশলের অংশ। সর্বশেষ বৈশ্বিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত ডেঙ্গু প্রতিরোধক টিকা দেওয়ারও পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখন থেকে সারা বছর চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ২০২৩ সালে তিন হাজারেরও বেশি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ বছরও এ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। প্রত্যেক মেডিকেল কলেজে আলাদাভাবে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে এ সংক্রান্ত সেন্ট্রাল ডেথ রিভিউ কমিটিকে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নির্মাণাধীন ভবনে নিয়মিত পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করা হবে। ঠিকাদার বা নির্মাতাদের এ বিষয়ে জানানো হবে, পরিদর্শন করা হবে। প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

এছাড়া কারখানা, অফিস, বাড়ি, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন সংস্থাগুলো বছরব্যাপী ভেক্টর কন্ট্রোল কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

এছাড়া ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ডেঙ্গু বিষয়ে সচেতনতামূলক বার্তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কীট, স্যালাইন, অন্যান্য ওষুধপত্র মজুদ রাখা এবং জরুরি প্রয়োজনে সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব বিষয়ে আলাদা বরাদ্দ রাখা হবে বলে জানান তিনি।

গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় পুরো দেশেই প্রয়োজনীয় স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়, যা যথাযথ সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব তুলে ধরে।

বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ : স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এডিস মশার প্রজনন বাড়াচ্ছে। যা এই রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের বড় চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে এই মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করার ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণের অভাব, ক্রমবর্ধমান অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ডেঙ্গু ভাইরাসের একাধিক সেরোটাইপ এবং রোগীর উপসর্গের পরিবর্তন, জনসচেতনতার অভাব এবং শহর থেকে গ্রামে রোগের ব্যাপক বিস্তার হওয়া অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close