মহসীন শেখ, কক্সবাজার

  ১৪ মার্চ, ২০১৯

সশস্ত্র পাহারায় ধ্বংস করা হচ্ছে উপকূলীয় বেষ্টনী

কক্সবাজারের চকরিয়ায় সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে এক সপ্তাহেই কেটে নেওয়া হয়েছে ১০ লাখ গাছ। এসব গাছ কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে দেড় হাজার একরের সরকারি বনাঞ্চল। ওই জমিতে এখন চিংড়ি চাষের জন্য দেওয়া হচ্ছে বাঁধ। এর পাশাপাশি চলছে আরো শত শত একর বনাঞ্চলের গাছ নিধনের প্রতিযোগিতা। অবৈধ এই কাজে পাহারায় রয়েছে শতাধিক অস্ত্রধারী। উপকূলের সবুজ বেষ্টনী হিসেবে পরিচিত বাইন, কেওড়া, গেওয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্মের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এই প্যারাবনে (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট) ধ্বংসযজ্ঞ চলছে চকরিয়ার চরণদ্বীপ মৌজার সুন্দরবন ও গোলদিয়ার চরে।

চকরিয়া উপজেলার ২১ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত উপকূলীয় বন বিভাগের সুন্দরবন রেঞ্জ। ওই রেঞ্জের চরণদ্বীপ মৌজার রামপুর, চরণদ্বীপ, চীলখালি, গোলদ্বিয়া এলাকায় জেগে উঠা চরে গত প্রায় একমাস ধরে এমন বেআইনি কাজ চললেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এদিকে প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়ি ঘের তৈরির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের একটি আদেশ বাস্তবায়নের জন্য তিন সচিবসহ ১৩ সরকারি কর্মকর্তাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এ প্রসঙ্গে জানা গেছে, ‘চকরিয়ায় সুন্দরবনের প্যারাবন ধ্বংসের বিষয়ে করা একটি মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া মামলায় বন সংরক্ষণের জন্য রুল ও বনের জমি চিংড়ি চাষের জন্য ইজারা না দিতে আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। এখন আবারও সুন্দরবনে প্যারাবন কাটা হচ্ছে জেনে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করবে।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপকূলীয় বন বিভাগের সুন্দরবন রেঞ্জে ২১ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমি ছিল। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টর ছিল সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এই আয়তনের ২৮ শতাংশ জুড়ে ছিল সুন্দরী, কেওড়া, গেওয়া, বাইন, গরানসহ ৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন বন্যপ্রাণির আবাসস্থল। কিন্তু ওই সুন্দরবন এখন বিলুপ্তির পথে। এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা বলছেন, সরকার এই সুন্দরবন ধ্বংসের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে চিংড়ি চাষ হিসেবে জমি ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, চিংড়ি চাষের জন্য ১৯৭৮ সালে চকরিয়া সুন্দরবনের ৫ হাজার একর এবং ১৯৭৯ সালে ১ হাজার ৭১৮ একর বনাঞ্চল সরকার মৎস্য বিভাগে হস্তান্তর করে। ১৯৮৫ সালের ২১ নভেম্বর এক গেজেটের মাধ্যমে আরো ৭ হাজার ৫৬৪ একর বনাঞ্চল ভূমি মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। এসব বনাঞ্চল চিংড়ি চাষের উপযোগী ব্যাখ্যা দিয়ে তা চিংড়ি চাষের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে ইজারা দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন সময় আরো কয়েক হাজার একর বনাঞ্চল ইজারা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এর অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করার পর ক্ষমতাসীন দলের কক্সবাজার জেলা ও চকরিয়ার প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার ইশারায় অর্ধশতাধিক সুবিধাবাদী ব্যক্তি নতুন করে উপকূলীয় এলাকার চকরিয়ার চরণদ্বীপ মৌজায় কয়েক হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস করে সেখানে চিংড়ি চাষের জন্য জমি তৈরি করছে। এসব বনাঞ্চলের গাছ কেটে পরিষ্কার করে তা ইজারা নিতে জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, চকরিয়ার সুন্দরবন রেঞ্জের চরণদ্বীপ মৌজার রামপুর, চরণদ্বীপ, চীলখালি, গোলদ্বিয়াসহ আশপাশের প্রায় দেড় হাজার একর চরজমিতে প্যারাবন কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। শত শত শ্রমিক সেখানে প্যারাবন নিধনের কাজে ব্যস্ত। ছোট আকারের ফেরিতে করে বিশেষ কায়দায় সেখানে নেওয়া হয়েছে এস্কাভেটর। এস্কাভেটর এবং শ্রমিক দিয়ে বনাঞ্চল ও নদীর মধ্যেই দেওয়া হচ্ছে বাঁধ। শতাধিক অস্ত্রধারী সেখানে পাহারায় রয়েছে। সাংবাদিক ও পরিবেশ কর্মীদের একটি দল সেখানে পরিদর্শনে গেলে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ধাওয়া করা হয়।

স্থানীয়রা জানান, প্যারাবন নিধনের কাজে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। তাদের ইশারায় মূলত সন্ত্রাসী-ডাকাত শ্রেণির লোকজন দিনে-রাতে প্যারাবন ধ্বংস করে চলেছে। এভাবে প্যারাবন ধ্বংস করা হলে উপকূলের মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে। প্রশাসনকে মৌখিকভাবে অনেকেই অভিযোগ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। এ বিষয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ কথা বলতে রাজি নন। এভাবে প্যারাবন ধ্বংসের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, প্যারাবন নিধন করা হচ্ছে বলে শুনেছি। দ্রুত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুদ্দীন মুহাম্মদ শিবলী নোমান বলেন, এসিল্যান্ড ও পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তাকে সেখানে পাঠানো হবে।

জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার বলেন, এরই মধ্যে প্যারাবন দখল করে চিংড়ি ঘের নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসকারীরা যেই হোক তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, প্যারাবন ধ্বংসকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে আমি দ্রুত সময়ের মধ্যে ইউএনও’র সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close