নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২১ আগস্ট, ২০১৮

ঈদযাত্রা

বাসে অতিরিক্ত ভাড়া ট্রেন-লঞ্চে ভোগান্তি

ঈদের আগে গতকাল ছিল শেষ কর্মদিবস। তাই অফিসে কোনোরকম হাজিরা দিয়েই বাড়ির পথ ধরেন নগরবাসী। উপচে পড়া ভিড় ছিল ট্রেন ও লঞ্চে। ফলে ভোগান্তিও ছিল অন্যদিনের তুলনায় বেশি। আর বাসে ছিল অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার প্রতিযোগিতা। এমন ভোগান্তি নিয়েই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে প্রবল ভিড়ের মধ্যে ট্রেনের অপেক্ষায় দীর্ঘ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ঘরমুখো যাত্রীদের। আর বাসের জন্য অনেককে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে। ঈদের দুদিন আগে গতকাল সোমবার রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, গাবতলী, কল্যাণপুর ও টেকনিক্যাল মোড়ের বাস কাউন্টার ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে এই চিত্র দেখে গেছে। মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সেখানে এক লাফে ৩০০ টাকার ভাড়া ঠেকেছে ৮০০ টাকায়। আবার গাড়িও মানহীন। এদিকে, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ঢাকা ছেড়ে যেতে সদরঘাটে লঞ্চের কেবিনের টিকিটের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। অনেকেই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও মেলাতে পারেননি কেবিনের টিকিট। অনেককেই মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে, গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল আকস্মিক পরিদর্শনকালে ঘরমুখী যাত্রীদের কাছে ক্ষোভের কথা শুনলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল। যাত্রীদের অভিযোগ কাউন্টারে অতিরিক্ত টাকা ছাড়া টিকিট মিলছে না। নিকট দূরত্বের যাত্রীরা পড়েছেন আরো বিপাকে। ৪০-৬০ টাকার ভাড়া নেওয়া হয়েছে দেড় শ-দুই শ টাকা। গতকাল বিকেল ৪টায় রাজধানীর আন্তজেলা বাস টার্মিনাল ও গাবতলীর পশুর হাট পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার সঙ্গে ছিলেন আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জমান মিয়া।

টার্মিনালে যাত্রীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়কালে যাত্রীরা বাস সংকটের কথা জানান। পাশাপাশি কাউন্টারে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগও করেন। বাড়তি টাকা ছাড়া টিকিট মিলছে না। একাধিক যাত্রীর কাছে এমন অভিযোগ শুনে সমাধানের আশ্বাসও দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বাস টার্মিনাল ও পশুর হাট পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী বলেন, ঈদের সময় সবাই বাড়ি যায়। ঈদে ঘরমুখী মানুষ যাতে অস্বস্তিতে না পড়ে, তারা যেন সুন্দরভাবে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারে সে চেষ্টা করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও টিকিটের স্বল্পতা রয়েছে।

‘টিকিট নেই বলা হলেও এখন টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে বেশি’ এ নৈরাজ্যের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, প্রত্যেক কাউন্টারের সামনে ভাড়ার চার্ট টাঙানো হয়েছে। আমরা সবাইকে বলেছি- অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে।

ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা ও পরিবহন নৈরাজ্যের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, লাখ লাখ মানুষ গাবতলীতে আসছে। বাস আসতেও সময় লাগছে। আশা করছি, সময়মতো সবাই গন্তব্যে যেতে পারবে। রোজার ঈদে এ সমস্যা না থাকলেও কোরবানিতে হচ্ছে। একমুখী চলাচলের ব্যবস্থার পরও গরুর রাস্তা পারাপার ও গরুর গাড়ি চলাচলে একটু সমস্যা তো হচ্ছেই।

মহাখালী ঘুরে দেখা গেছে, সব রুটেই গাড়ির সংখ্যা কমেছে। এ জন্য গাড়ি পেতে ঈদমুখী যাত্রীর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা, সোনার বাংলা বা ড্রিমল্যান্ড সার্ভিসের কোনো গাড়ি নেই। অন্য রোডের কয়েকটি গাড়ি শেরপুর যাবে বলে কাউন্টারের বাইরে টিকিট বিক্রি করছে। দাম প্রতিসিটে ৮০০ টাকা।

কারণ জানতে চাইলে টিকিট বিক্রেতা আকতার হোসেন বলেন, গাড়ি নেই। এটাতে না গেলে আর গাড়ি পাবেন না। কোন গাড়ির সিট বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গাড়ি যে রুটের হোক সমস্যা নেই। শেরপুর যাবে। পরে জানা গেল, ঢাকা থেকে হালুয়াঘাট রুটের গাড়ি যাচ্ছে শেরপুরে। নাম শ্যামলী বাংলা। আশপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক নেই। ফলে অভিযোগ করারও সুযোগ নেই বললেন যাত্রী হোসনে আরা।

কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রংপুর এক্সপ্রেস সকাল ৯টায় এবং লালমনি ঈদ স্পেশাল ট্রেন বেলা সোয়া ৯টায় ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু রংপুর এক্সপ্রেস বেলা সাড়ে ১২টার দিকে প্ল্যাটফর্মে এসে ১টার দিকে স্টেশন ছেড়ে যায়। আর লালমনিরহাট ঈদ স্পেশাল ঢাকা ছাড়ে বেলা পৌনে ৩টায়।

রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার কথা সকাল ৬টায়। প্রায় তিন ঘণ্টা দেরি করে বেলা ৮টা ৫০ মিনিটে কমলাপুরে পৌঁছানো পর বেলা সোয়া ৯টায় যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি কমলাপুর ছাড়ে। এ ছাড়া সুন্দরবন এক্সপ্রেস সকাল ৬টা ২০ মিনিটের পরিবর্তে বেলা সাড়ে ৮টায়; দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল পৌনে ৯টায় জায়গায় সোয়া ৯টায়; চিলাহাটির নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল ৮টার জায়গায় চার ঘণ্টা দেরি করে বেলা ১২টায় ঢাকা ছাড়ে।

দেওয়ানগঞ্জের তিস্তা এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৭টার পরিবর্তে ছেড়ে যায় সাড়ে ৯টায়। তবে দিনাজপুরের একতা এক্সপ্রেস খুব বেশি দেরি করেনি। বেলা ১০টার বদলে ট্রেনটি রওনা হয়েছে ১০টা ১০ মিনিটে। এদিকে, ট্রেন ছাড়তে দেরি হওয়ায় ভাদ্র মাসের গরমে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীদের।

কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্ত্তী জানান, সোমবার সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৫টি ট্রেন কমলাপুর ছেড়ে গেছে। ট্রেন ছাড়তে দেরির কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ট্রেন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। এ কারণে ট্রেনগুলো দেরিতে পৌঁছায়। ফলে সেগুলো আসতেও দেরি করে। এ কারণে উত্তরবঙ্গের ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ডাবল লাইন করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গাবতলীতে বাসের কাউন্টার ব্যবস্থাপকরা বলছেন, ফেরার সময়ে মহাসড়কে যানজটের কারণে বাস ঢাকায় আসতে দেরি হচ্ছে, সে কারণে দেরি। উত্তরাঞ্চলের রুটে টাঙ্গাইলে যানজটের কারণে গাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রুটের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে জটের কারণে ওই দেরি। অনেক অপেক্ষা করেও প্রিয়জনের টানে ঢাকা ছাড়ছেন ঘরমুখো মানুষ; কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেরির সময় বেশ কয়েক ঘণ্টাও ছাড়িয়েছে।

দুটি বাস দেরির কারণ জানতে চাইলে গাবতলী এলাকার যানজটকে দায়ী করেন শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর কাউন্টারের ব্যবস্থাপক শাহজাহান সিরাজ। গাবতলীতে গাড়ি ঘুরতে দেরি হচ্ছে, একে তো মানুষের চাপ আবার গরু বাজার। এখন পর্যন্ত মহাসড়কে তেমন যানজট নেই।

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে পারাপারে সময় তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে বলে জানান এসডি পরিবহনের গাবতলী কাউন্টারের ব্যবস্থাপক শেখ গোলাম রাব্বী স্বপন। চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরা ও যশোর রুটে চলে তাদের বাস। মানুষের চাপ আর গরুবাহী গাড়ির কারণে রাজধানীর শ্যামলী এলাকা থেকে গাবতলী পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট দেখা যায়। তবে গাড়ি চলতি অবস্থায় রাখতে ব্যস্ত ছিলেন পুলিশ সদস্যরা।

সদরঘাটে লঞ্চ টার্মিনালে দেখা গেছে, যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। লঞ্চ কর্মচারীদের কেউ কেউ দ্বিগুণ টাকা নিয়ে কেবিন ভাড়া দিয়েছেন বলে অভিযোগ অনেকের।

পিরোজপুর যাওয়ার উদ্দেশে পরিবার নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়েছিলেন ব্যবসায়ী ইমদাদুল ইসলাম। বেলা ১১টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছান তিনি। কিন্তু তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও পিরোজপুর রুটের কোনো লঞ্চে কেবিনের টিকিট পাননি। তাই বাধ্য হয়ে রাজদূত-৭ লঞ্চে সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে কেবিন নেন। নরমাল সময়ে এ টিকিটের দাম আড়াই হাজার টাকা। প্রতিটি লঞ্চের ডেকের ভিতরে, ছাদে ও অন্যান্য স্থানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। বিছানা চাদর, মাদুর বা গামছা-লুঙ্গি বিছিয়ে যেভাবে পরছেন জায়গা দখল করে বসে পড়েছেন। কেউ আবার লঞ্চের কোনো স্থানে একটু দাঁড়ানোর সুযোগ পেলেই ঘাপটি মেরে থাকছেন। অনেকে আবার পরিবার নিয়ে লঞ্চে উঠে দাঁড়ানোর জায়গা না পেয়ে হতাশ হয়ে নেমে পড়ছেন।

বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সদরঘাটে পরিদর্শনে আসা নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, বাড়তি ভাড়া নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি অভিযোগ পাওয়া যায় তবে রুট পারমিট বাতিলসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য কয়েকটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ পেলেই তারা ব্যবস্থা নেবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close