আব্দুর রহমান

  ২৪ আগস্ট, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

সিরিয়া-মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্ব

বিশ^ রাজনীতিতে সংকটের অপর নাম মধ্যপ্রাচ্য। মুসলিম জাহানের শিয়া-সুন্নি বর্ণ দ্বন্দ্ব, রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে মার্কিন ও ইসরায়েলের দাসত্ব, অস্ত্র-তেল ব্যবসার নিমিত্তে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যের আগ্রাসননীতি মূলত মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অন্যতম কারণ।

এখানে অন্য কেউ নয়, মুসলমানরাই মুসলমানদের অন্যতম শত্রু। এর আগে পশ্চিমা আগ্রাসনে মিথ্যা অপবাদে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। লিবিয়ার গাদ্দাফিকে হটিয়ে পুতুল সরকার বসানো, মিসরের গণতান্ত্রিক মুরসি সরকারকে হটিয়ে সেনা সরকার প্রতিস্থাপন এবং গত ৫ জুন কাতারকে কাত করে তার অর্থনীতি করায়ত্ত করতে ও তেল সম্পদ লুণ্ঠনের মানসে পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনে সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশের অবরোধ আরোপ। শকুনের গলায় মালা আর আবাবিলের পায়ে তালা দেওয়া বন্ধ না হওয়া অবধি সংকট পিছু ছাড়বে না মধ্যপ্রাচ্যের।

সিরিয়া ইস্যুতে নানামুখী সংকটে বর্তমান বিশ্বরাজনীতি। ২৪ আগস্ট বুধবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মস্কো সফরে আসছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর এ সফর বিশেষ কিছু ইঙ্গিত বহন করে। বলে রাখা ভালো, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার বাশার সরকারকে সামরিক ও কূটনৈতিকভাবে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে আসছে রাশিয়া। গত ১ এপ্রিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে আনা একটি নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো দেওয়ায় টানাপড়েনের সূত্রপাত। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা প্রাপ্ত পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। অপর সদস্য চীন ভোটদানে ছিল বিরত। দেশটির ছয় বছরের গৃহযুদ্ধে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সরকারের সমর্থনে রাশিয়া অষ্টমবারের মতো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করল। মুসলিমবিদ্বেষী ট্রাম্প প্রশাসন গত ৪ এপ্রিল আইন অমান্য করে সিরিয়ার একটি বিমান ঘাঁটিতে ৫৯টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। আবার চলতি মাসের ৭ আগস্ট মার্কিন বিমানবাহিনীর হামলায় ৩০ জন বেসামরিক সিরীয় নাগরিক মারা যায়। মার্কিন সরকারের অভিযোগ, বাশার সরকার আইএস-বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খান শেইখৌন শহরে রাসায়নিক অস্ত্র (বিষাক্ত গ্যাস) ব্যবহার করে শিশুসহ ৬০ নাগরিককে হত্যা করেছে। অপরপক্ষে বাশার আল আসাদ সরকার তার ওপর আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দায় চাপিয়েছে আইএসের ওপর। সভ্য পৃথিবীতে এমন বর্বর হামলা অমানবিক ও নিন্দনীয়। তবে কার দাবি সত্য, এই নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব আজ দ্বিধাবিভক্ত। কেননা একই অভিযোগ এনে মার্কিন সরকার ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে হটিয়েছিল। যা জাতিসংঘ গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ইরাকের পর সিরিয়ার সরকার উৎখাতে তৎপর পশ্চিমা বিশ্ব। আবার গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।

স্বাধীন-সার্বভৌম সিরিয়ায় মার্কিন আগ্রাসন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল ইরান ও রাশিয়া। ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন হুশিয়ারি দিয়েছিলেন, সিরিয়ার ওপর আবারও অন্যায়ভাবে আক্রমণ হলে কড়া জবাব দেবে ওই দুই দেশ। এ প্রেক্ষিতে মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ককে স্বাভাবিক করতে গত ১৩ এপ্রিল পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। অপরপক্ষে গত ১৪ এপ্রিল সিরীয় ইস্যুতে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে মস্কোতে বৈঠক করেন ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ, সিরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ মোয়ালেম ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সিরিয়ার অখ-তা রক্ষা ও পশ্চিমা বিশ্বের অযাচিত হামলা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করবে তিন দেশ। এতে মার্কিন আগ্রাসনে ইরাক, আফগানিস্তান জয় করতে পারলেও সিরিয়া জয়ে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। তাই রাশিয়াকে ম্যানেজ করতেই নেতানিয়াহুর মস্কো সফরÑএমনটাই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।

ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ১৯টি দেশ নিয়ে গঠিত মধ্যপ্রাচ্য। দেশগুলো খনিজ তেলে সমৃদ্ধ। তেল ভা-ার লুণ্ঠনে ও অস্ত্র ব্যবসা করতেই মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ জিইয়ে রেখেছে পশ্চিমাবিশ্ব। তেলের বিনিময়ে করছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের আধিপত্য অক্ষুণœ রাখতে মার্কিন সরকার সর্বদাই রয়েছে সক্রিয়। কথিত আছে যে, জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদা ও আইএসের উত্থান নাকি মার্কিন-ইসরায়েলের সৃষ্টি। তথ্য মতে, আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করতে সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনকে নাকি আমেরিকা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েছিল। লাদেন পরবর্তীতে আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠা করেন তালেবান সরকার এবং গঠন করেন নিজস্ব সংগঠন আল-কায়েদা। সেই লাদেনই ২০০১ সালের ৯ নভেম্বর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে তাকে সৃষ্টিকারী মার্কিন মুলুককে ধ্বংস করতে ভয়াবহ বিমান হামলা চালায় টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে। এতে তৎকালীন মার্কিন সরকার লাদেনকে নিশ্চিহ্ন করতে আফগানিস্তান দখল করে এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করে। অভিযোগ রয়েছে, মার্কিন আধিপত্য রক্ষা করতে এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র পরোক্ষ সহযোগিতা ও ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ সমর্থনে আইএস পরিচালিত। এমন অভিযোগও রয়েছে যে, আইএসের কর্ণধার খলিফা আবু বকর আল বোগদাদী ইসরায়েলের নাগরিক।

পশ্চিমাবিশ্ব মানবাধিকারের ফতোয়া দিয়ে নিজেরাই প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করে চলেছে মানবাধিকার। অতীতে মিথ্যা রাসায়নিক অস্ত্রের অভিযোগ এনে ইরাকের সাদ্দাম সরকার হটিয়ে ইরাক দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে আইএসের অপতৎপরতা ও গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়ছে মানবতা, মরছে নিরীহ মানুষ। সে আগুন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সিরিয়াতেও। এখন সিরিয়া দখল করতে একই পদ্ধতি অনুসরণ করছে পশ্চিমাবিশ্ব। আমরা চাই না সিরিয়ার ভাগ্য ইরাকের মতো হোক। এমনও হতে পারে, সিরিয়া জয় করতে মার্কিন সরকারই হয়তো গোপনে আইএস-কে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। যাই হোক, মার্কিনিদের এমন অন্যায় আগ্রাসন বন্ধে, আইএস নির্মূলে, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইরান ও রাশিয়ার মতো জাগ্রত হোক বিশ্ববিবেক। ঐক্যবদ্ধ হোক মুসলিম উম্মাহ। কিন্তু কীভাবে! সৌদি আরবসহ প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো চলছে উল্টো পথে। তাই আজ পদে পদে নির্যাতিত নিষ্পেষিত হচ্ছে মুসলিম সমাজ। বিশ্বের দুইশ’ কোটি মুসলিম ঐক্যবদ্ধ হলে মুসলিম মানবতা, নির্মম নির্যাতন ও হত্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে ফিলিস্তিন-সিরিয়ার অসহায় মানবশিশুরা। অতীতের একটি ছবি বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সিরীয় মৃত শিশু আইলানের লাশ। সুতরাং সেখানকার শিশুদের বাঁচাতে, মানবতা-মানবাধিকার রক্ষায়, নিরাপদ ও আগ্রাসনমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হোক বিশ্ব সমাজ-এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist