মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ০৭ মার্চ, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

সোনার দেশ গড়ায় মার্চের অঙ্গীকার

একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্সে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মুক্তিকামী মানুষের মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর সমগ্র বাঙালি নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণে উপস্থিত জনগণ তাদের আগামী দিনের কর্মপন্থার এক সঠিক নির্দেশনা পান, যার সূত্রপাত ঘটেছিল বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে বীর শহীদদের রক্তদানের মধ্য দিয়ে। রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর সেই তেজদীপ্ত কণ্ঠস্বর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শুধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বান দিয়েই শেষ হয়নি বরং স্বাধীনতার অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ রূপরেখাও ছিল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায় সূচিত হয় এবং প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মনে, স্বপ্নে লাল-সবুজের পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ও মুক্তির দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, যা লিখিত আকারে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুরই পক্ষে বেতারে একাধিকবার প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৮ মার্চ থেকেই স্বাধীনতার পথে এগোতে থাকে বীর বাঙালি। পাড়ায়-মহল্লায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ছাত্রাবাসে, বাসভবনে কালো পতাকা ওড়ানো হয়। সবকিছু চলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ৯ তারিখ থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ, হরতাল। চারদিকে মানুষের মিছিলে মিছিলে ছেয়ে যায় রাজপথ। চলতে থাকে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি। বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং পাড়ায়-মহল্লায় শুরু হয় ট্রেনিং। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কিন্তু পঁচিশ মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে নিরস্ত্র সাধারণ বাঙালির ওপর অতর্কিতে যে কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে, শুরু করবে নির্বিচার নির্মম হত্যাযজ্ঞ, তা বোধহয় কেউ বুঝতে পারেনি। রাত একটু গভীর হতেই গোলাগুলির বিকট শব্দ বাড়তে থাকে, আকাশ জুড়ে মর্টার শেলের লেলিহান শিখা। আকাশটা গর্জে উঠে যেন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে ঢাকার বুকে। আগুনের লেলিহান শিখা যেন পুড়ে ছারখার করে ফেলবে সব। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাতে পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অতর্কিতে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি হানাদাররা। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। আমি যে কলেজে শিক্ষকতা করতাম, সেই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অবাঙালি। আমার কিছু অবাঙালি সহকর্মীর চেহারাও পঁচিশ মার্চের পরে পুরোপুরি পাল্টে যায়। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন সব বাঙালি শিক্ষক, কর্মচার এমনকি ছাত্ররাও। কারফিউ ভাঙলে আমরা বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। ঢাকা শহর জুড়ে তখন জনতার মিছিল। হায়েনার আক্রমণ থেকে বাঁচতে সবাই ছুটছে দিগবিদিক। কোথায় গন্তব্য তা কেউ জানে না। কোথাও কোনো যানবাহন নেই। তখন চারদিক চলছে পাকিস্তানি আর্মির গোলাগুলি। গ্রামগঞ্জ দাউ দাউ জ্বলে-পুড়ে ছারখার। জোয়ান-তাজা যাকে পাচ্ছে তাকেই ওরা নির্মমভাবে হত্যা করছে, তা থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। নারীরা হচ্ছে ওদের অমানবিক পাশবিকতার শিকার।

বাঙালির জাতীয় জীবনে দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম, শোষণ-বঞ্চনা আর ত্যাগ-তিতিক্ষার সুদীর্ঘ পথ ধরেই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। দেশের সব মুক্তিকামী সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল মহান এ যুদ্ধে। মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন দেশের অগণিত কবি, লেখক, গায়ক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণি-পেশার জনগণ। অনেকে লেখালেখি করে, গান গেয়ে বা নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করে যুদ্ধের অর্থের জোগান দেন। বন্দিশিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেন দেশের বহু চিকিৎসক ও নার্স। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের উন্মত্ততার শিকার হন দেশের অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষ। ওরা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বাংলার লাখ লাখ ঘরবাড়ি ও হাটবাজার। লুটপাট করে বাংলার মানুষের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। ওদের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায়নি দেশের নারী, শিশুরাও। প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা দিতে শত চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। শরণার্থীশিবিরে প্রায় তিন লাখ শিশু অপুষ্টিতে মারা যায়। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হন। খুন, ধর্ষণের শিকার হয় দেশের দুই লক্ষাধিক নারী। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের দিন পর্যন্ত চলে এ হত্যাযজ্ঞ। চৌদ্দই ডিসেম্বরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওদের দোসরদের সহযোগিতায় চালায় এ দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস অভিযান। ওরা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য ও অকার্যকর করতে ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। হানাদার বাহিনীও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. জিসি দেব, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, সেলিনা পারভীন, ড. ফজলে রাব্বি, শহীদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. গোলাম মর্তুজা, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, সাংবাদিক নিজামুদ্দীন আহমদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, আবুল খায়ের, আর পি সাহা, রশীদুল হাসান, নতুন চন্দ্র সিংহ, খন্দকার আবু তালেব, ড. মুক্তাদির, ড. সাদেক, আলতাফ মাহমুদসহ বহু প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির মানুষ। পাকিস্তানি হানাদাররা এসব শহীদের দেহ মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেলে রাখে। গ্রামবাংলার নদ-নদী, খাল-বিলে ভাসতে থাকে অগণিত লাশ। শিয়াল, কুকুর, শকুন ছিঁড়ে খায় বাংলার অগণিত মানুষের গলিত দেহ। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যাযজ্ঞ দেখে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয় কেঁপে ওঠে। খোদ নিউ ইয়র্কের র‌্যাডিসন স্কোয়ারে মার্কিন পপতারকা জর্জ হ্যারিসন ও ভারতীয় সুর সম্রাট রবিশঙ্কর কনসার্ট করে তহবিল সংগ্রহ করেন। পৃথিবীর বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে আসে সাহায্য-সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয়। ভারতের মিত্রবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বাত্মক সাহায্য করে।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রায় তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আসে চূড়ান্ত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন, সার্বভৌম এক দেশ, বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র চার বছরের মধ্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তারপর চার জাতীয় নেতাকেও নির্মমভাবে কারাগারে গুলি করে মারা হয়। দেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা হতে থাকেন উপেক্ষিত। এ থেকে মুক্তি পেতে হবে। যারা জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন, তাদের জীবনমানের উন্নয়নের নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অবশ্য ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বীরঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এসবই আশার কথা।

বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম। বাঙালির বিরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল জাতীয় ঐক্যের মূল চালিকাশক্তি, যার আবেদন আজও এতটুকু ম্লান হয়নি। এই গর্বকে বুকে ধারণ করে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে নতুন প্রজন্মের সামনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গৌরব গাঁথা তুলে ধরতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সন্নিবেশিত করে বিস্তৃতভাবে তাদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমানে শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি যতটা তুলে ধরা হয়, তা যথেষ্ট নয়। উচ্চতপর্যায়ের শিক্ষায় বৃহত্তর কলেবরে গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ সংযোজিত হওয়া জরুরি। শিশু-কিশোরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নিতে হবে। যে মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এ দেশের লাখো মুক্তিকামী মানুষ একাত্তরে বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল, তাকে সফল করে তুলতে হলে নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে হবে। ভুলিয়ে দিতে হবে সব দ্বিধা, সংশয় ও ভেদাভেদ। একাত্তরের ১৫ মার্চের স্বাধীনতা এবং ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস পালনের মাঝেই আমাদের কর্তব্যের শেষ নয়। সবার বছর, সারাক্ষণ আমাদের চেতনায়, কর্মে মুক্তিযুদ্ধকে লালন করে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবে রূপদান করতে হবে। দেশজুড়ে গড়ে তুলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে, দিতে হবে যথাযথ সম্মান। মুক্তিযোদ্ধাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব তুলে দিতে হবে নতুন প্রজন্মের হাতে। ওদের মাঝে যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা আর দৃঢ় প্রত্যয়। ওদের রোখার শক্তি কারো নেই। নতুন প্রজন্মের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ। ওদের সৎ ও আত্মত্যাগের মানসিকতায় গড়ে তুলতে হবে। একাত্তরের ৭ মার্চের রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা শব্দটির আগে যে মুক্তি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল, তাকে সফল করে তুলতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তরঞ্জিত রাজপথ ও সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোনের অশ্রুভেজা পথ ধরে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মুক্তির পথে গড়ে তুলতে হবে এক শোষণহীন, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ...।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close