ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

মিয়ানমারের চলমান ‘সিভিল ওয়ার’ ও রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ

মিয়ানমার এখন বাংলাদেশের মিডিয়ার একটা নিয়মিত ‘নিউজ আইটেম’। কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া মিয়ানমারের গরম গরম খবর যথাক্রমে প্রকাশ ও প্রচার করছে। মিয়ানমারে সামরিক সরকারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র লড়াই হচ্ছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর কাছে সেনাবাহিনীর পরাজয়ের খবর আমরা দেখতে পাচ্ছি। এসব সংবাদে আমরা খানিকটা পুলকিত হচ্ছি বটে; কিন্তু মিয়ানমারের জনগণের জন্য এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের সংবাদ। কারণ এর মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে এবং সামরিক জান্তার হাত থেকে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে। বাংলাদেশে এ খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ এবং প্রচার করার পেছনের তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে। এক. মিয়ানমারের রাজনৈতিক ডামাডোলের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ জড়িত। যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ, সেহেতু মিয়ানমারের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথকে উন্মুক্ত রাখবে এবং সুগম করবে। এ কারণেই মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের মানুষের জন্য মনোযোগ দাবি করে। ফলে মিডিয়া সেটাকে লুফে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। দুই. রোহিঙ্গা ইস্যুর বাইরেও একটি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আঞ্চলিক ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কী ঘটছে, সেটা বাংলাদেশের জন্য গভীর আগ্রহের কারণ আছে। তাই বাংলাদেশের মিডিয়া গুরুত্বের সঙ্গে মিয়ানমারের সিভিল ওয়ারের খবর প্রকাশ ও প্রচার করছে এবং ভোক্তা হিসেবে পাঠক ও দর্শক সেটা আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করছে। তিন. বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে আমরা জানি যে, রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যে তুমুল যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তার কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দিবারাত্রি গোলাগুলির শব্দের কারণে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় যে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে, তার ফলে নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম এলাকার পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বাইশ ফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম কুল তমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) গত ২৯ জানুয়ারি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তা ছাড়া সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করার কারণে নিয়মিতভাবে মর্টারশেল বাংলাদেশের সীমানায় এসে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের তরফ থেকেও সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের টহল ও প্যাট্রলিং জোরদার করা হয়েছে। ফলে এটাও স্বাভবিক কারণে মিডিয়া ফোকাস পায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমারের এই চলমান সিভিল ওয়ারে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী?

ইতিহাস আমাদের জানান দেয়, ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হলেও সাতটি রাজ্যের বিভিন্ন স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী তাদের আঞ্চলিক স্বাধীনতার দাবি করায় শুরু থেকেই উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় এথনিক মেজরিটি হিসেবে মিয়ানমার জাতিগোষ্ঠীর একাধিপত্য এবং একক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ মিয়ানমান রাষ্ট্রক্ষমতা এবং শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে এক ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়। ১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী মিয়ানমার ক্ষমতা দখল করলে, এসব স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষগুলো নতুন করে নিপীড়নের শিকার হয়। তখন তারা জান্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এবং নিজের স্বতন্ত্র সত্তার স্বীকৃতি ও নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করতে থাকে। যে কারণে তাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘বিদ্রোহী দল’, ‘সশস্ত্র গোষ্ঠী’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের চোখে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী হলেও সীমান্তবর্তী তাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর কাছে তারা স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিকামী জনতা। কিন্তু বর্তমান মিলিটারি জান্তার বিরুদ্ধে তাদের লড়াইটা স্বীকৃতি পেয়েছে গণতন্ত্রের মুক্তির লড়াই হিসেবে। তাই এটাকে বলা হচ্ছে ‘সিভিল ওয়ার’। এটা মিলিটারি সরকারের হাত থেকে গণতন্ত্রের মুক্তির লড়াই। তাই জান্তাবিরোধী এ লড়াইয়ে রয়েছে বিপুল জনসমর্থন। বিশেষ তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল এলাইয়েন্সের (এমএনএ) সমন্বয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গঠিত ‘ব্রাদাহুড এলায়েন্স’ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটা জোরদার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’। সিভিলিয়ানদের সরকার নামে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) আর্মড উইং পিপল্স ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সঙ্গে বিভিন্ন সীমান্তবর্তী স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে পুরো মিয়ানমারে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে তাদের হাতে পরাজিত হচ্ছে এবং সারেন্ডার করছে। রাখাইন রাজ্যেও আরাকান আর্মির কাছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরাজিত হচ্ছে এবং একের পর এক এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। আরাকান আর্মি দাবি করছে, রাখাইনের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। যদিও স্থানীয় সংবাদপত্র বলছে, এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা রাখাইনের ৫০ শতাংশের বেশি নয়। প্রকৃতপক্ষে, গোটা রাখাইন রাজ্যের ৫০ শতাংশ এলাকা আরাকান আর্মির দখলে, এটাও কম নয়। এ রকম অবস্থা চলমান থাকলে অচিরেই গোটা রাখাইন আরাকান আর্মির দখলে চলে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তখন রোহিঙ্গাদের অবস্থা কী হবে? যারা রাখাইনে বসবাস করছে এবং যারা বাংলাদেশে বসবাস করছে, তাদের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বাংলাদেশের অনেক গবেষক এবং বিশ্লেষক মনে করেন, যদি মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর পতন হয় এবং নতুন করে গণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় আসে এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে, তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে এবং মিয়ানমারে একটি অন্তর্ভুক্তিবাদী (ইনক্লুসিভ) সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। যদি সত্যিই এ রকম হয়, তাহলে আমিই সবচেয়ে বেশি আপ্লুত হতাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ রকম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না। আমরা জানি যে, ন্যাশনাল ইফনিটি গভর্নমেন্ট রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলছেন এবং তাদের ছায়া কেবিনেটে রোহিঙ্গা জাতিসত্তার একজনকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরাকান আর্মির প্রধান থোয়াইং ম্রা নাইং-ও দুটি সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। থোয়াইং ম্রা নাইংয়ের এ বক্তব্য অনেককে আশাবাদী করেছে এবং অনেক বিশ্লেষক এটাকে বেশ ইতিবাচক ইঙ্গিত হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, এসব কিছু কেবলই লোক দেখানো। কেননা এনইউজির প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং রিকগনিশন। যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশ সংবেদনশীল, সেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা ইতিবাচক অবস্থান নিলে, হয়তো আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যেতে পারে। একইভাবে আরাকান আর্মিও আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্তির আশায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে খানিকটা দেখানোপনা করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলেই ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত নেবে না। তাই আরাকান আর্মির রাখাইন দখল করা নিয়ে আমাদের পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনী কর্তৃক মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আগে এবং পরে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মধ্যে রোহিঙ্গা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির খানিকটা ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিটাকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কীভাবে দ্রুত করা যায়, সেদিকেই বাংলাদেশকে নজর দিতে হবে এবং সেটাকেই কাজে লাগাতে হবে।

লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক

নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close