সাইশা সুলতানা সাদিয়া

  ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

পাহাড়ের বুকে যন্ত্রের তাণ্ডব

প্রাকৃতিকভাবে এবং মনুষ্য কর্তৃক বন জঙ্গল ও গাছপালা কেটে উজাড় করার কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা সভ্যতার শুরু থেকেই ঘটে আসছে। পাহাড় ধসের জন্য কৃত্রিমভাবে পাহাড় কাটাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের গাঠনিক শক্তি ক্ষয়ে যায়। যার ফলে পাহাড় ধসে পড়ে। এর ফলে একদিকে যেমন উজাড় হচ্ছে পাহাড়, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ-প্রকৃতি, অন্যদিকে ঘুটছে প্রাণহানি।

পাহাড় কাটার কারণে পাহাড়ের বন্ধন দুর্বল হয়ে পাহাড় ধসের পথ সুগম করে দেয়। ফলে প্রতি বছরই পাহাড়ধসের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড় কাটার ঘটনা নতুন নয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেন সংঘবদ্ধ কিছু গোষ্ঠী পাহাড় কাটার উৎসবে মেতে উঠেছে। ‘প্রাচ্যের রানী’ ও ‘বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার’খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের অপরূপ সৌন্দর্যের উপাদান হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের সঙ্গে রয়েছে এই অঞ্চলের মানুষে আত্মিক বন্ধন। এ অবস্থায় পাহাড় কাটতে থাকলে এ শহরের ভৌগোলিক চরিত্র বদলে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা।

গবেষণা মতে, পাহাড়গুলো গ্রহের জটিল এবং আত্মনির্ভরশীল বাস্তুতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করে বলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে সংবেদনশীল। পাহাড়ের উলম্ব মাত্রার কারণে তারা তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং নিরুদকের গ্রেডিয়েন্ট তৈরি করে গ্রহকে রক্ষা করে। কিন্তু পাহাড় কাটার ফলে প্রবল বর্ষণে মাটির স্তরে স্তরে জলের স্রোত প্রবেশ করে পাহাড়ের মাটিকে গলিয়ে ফেলে এবং ফাটল সৃষ্টি করে। নিচের দিকে ধসে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলে। চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের দাবি অনুযায়ী, গত ৪ দশকে চট্টগ্রাম নগরীতে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১২০টি পাহাড়।

একদিকে পাহাড় ধসের ফলে যেমন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলুপ্ত হচ্ছে। পাহাড় পর্বতে থাকা জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। পাহাড় পরিবেশ আইন না মেনে প্রভাবশালীরা পাহাড় কেটে যাচ্ছে। প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকার স্থানীয় লোকরাও কিছু বলতে পারছে না। অনেকে রাত পর্যন্ত বুলডোজার দিয়ে পাহাড় কেটে ট্রাকে করে মাটি অন্যত্র বিক্রি করছে। পরিবার সুরক্ষা আন্দোলনের কর্মীরা জানান, প্রশাসনিকভাবে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ পরিবেশ ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে। প্রভাবশালী লোকদের থামাতে অবশ্যই প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পাহাড় নির্বিচারে কেটে নয়, বরং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনমতো কাটা উচিত।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, পারিবারিক বৃহৎ আকার প্লেট পৃথিবীর ওপরের শক্ত স্তর সৃষ্টি করে সেগুলো নড়াচড়া সংঘর্ষের ফলে উৎপত্তি ঘটে পর্বতমালা। যখন পরস্পর ধাক্কা লাগে এবং শক্তিশালী অন্য প্লেটের নিচে গড়িয়ে চলে যায়। তখন ওপরের প্লেটটি বেঁকে গিয়ে পর্বত উঁচু জায়গার জন্ম দেয়। এর মানে পরে ওপরের পর্বতগুলো দর্শনযোগ্য একটি অংশ হয়ে উঠে আর নিচের দিকে গভীর সমপরিমাণ বিস্তৃত থাকে। আর সেই ওপরের দর্শনযোগ্য জায়গাটি থেকেই আমাদের পর্যটন কেন্দ্রে সমৃদ্ধি আনে। ভূমির গভীরে বিস্তৃত জায়গাটি দৃঢ়ভাবে ভূপৃষ্ঠকে আঁকড়ে ধরে ভূমিকম্প ও বিভিন্ন দুর্যোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। আর সেজন্যই পর্বতমালাকে পৃথিবীর বিশাল রক্ষাকবচ বলা হয়। অথচ মানুষ এই রক্ষাকবচটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।

প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ধস সাধারণত বৃষ্টির কারণে বর্ষাকালে বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু পাহাড় কাটার ফলে সেটা সারা বছরের জন্য দুর্ভোগ টেনে আনবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা ও সর্বোপরি মানব জীবনের সুনিশ্চিত যাপনের জন্য পাহাড় কাটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ের বুকে যন্ত্রের থাবা বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর আইনের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই প্রভাবশালী হোক বা যেই হোক না কেন তাকে পাহাড় কাটা থেকে বিরত রাখা সম্ভব হবে। তা ছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে থেকে পরিবেশ ও বন-জঙ্গল রক্ষায় আমাদের সচেতন হতে হবে। কেননা বন-জঙ্গলের বড় একটা অংশ পাহাড়েই বিদ্যমান। পাহাড়-পর্বত আমাদের জন্য প্রকৃতির বিশেষ আশীর্বাদ, যার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close