মো. আজিজুর রহমান

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

দেশে এনজিওদের সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

প্রাথমিকভাবে এনজিওগুলো তাদের কাজ ত্রাণ ও পুনর্বাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও পরবর্তীকালে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নসহ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, নারীর ক্ষমতায়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে বিস্তৃতি লাভ করে। বলা যায়, আর্থসামাজিক উন্নয়নে এক ধরনের নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে এ দেশের এনজিওসমূহ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক উপাত্তে দেখা যায়, বর্তমানে কর্মসংস্থানের ৮৭ শতাংশ সৃষ্টি হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায়। অন্যদিকে ১৩ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর ’২৩ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ২৬০৭টি নিবন্ধিত এনজিও বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামীণ ও নগর অঞ্চলে প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়ন, সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কাজ করে চলেছে। গত কয়েক দশকে এনজিওসমূহের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি তাদের কর্ম উদ্যমও বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনায় এনজিওরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, অ্যাডভোকেসি, লিগ্যাল সাহায্য, পরিবেশ এবং অনুদান প্রোগ্রামসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের পার্টনার অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে উপকারভোগীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, এসডিজি-১-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দারিদ্র্য যাতে সর্বত্র যেকোনোরূপে দূরীভূত হয় এবং এসডিজি-৫-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন- এ দুটি অর্জনের ক্ষেত্রে বিএনএফের ২৩টি পার্টনার অর্গানাইজেশনের ৫২৬ জন উপকারভোগীর ওপর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দারিদ্র্যবিমোচনে এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতা অর্জনে এনজিওর দ্বারা উপকারভোগীদের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে।

কিছু সমস্যা : এনজিওদের নিয়ে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি হয়, বেশ কিছু বিষয় এনজিওসমূহের সার্বিক উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হলো-

১. ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম : কার্যত অনেক প্রতিষ্ঠানই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে শুধু ক্ষুদ্রঋণ প্রদান কর্মসূচিতেই মনোনিবেশ করছে। অনেক পরিবারের সাময়িক আর্থিক উন্নয়ন ঘটলেও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে দীর্ঘ মেয়াদে ওই টাকা কাজে লাগাতে না পারার ফলে আগের অবস্থার চেয়ে ভবিষ্যৎ আর্থিক অবস্থার আরো অবনতি হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। এতে পারিবারিক ভাঙনেরও সৃষ্টি হচ্ছে।

২. সুদের হার : এনজিওর সুদের হার নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন ও দ্বিধা রয়েছে। যদিও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি ক্রমহ্রাসমান ২৪ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে তথাপি এটি আরো কম হওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। তা ছাড়া কিছু কিছু এনজিও কর্তৃক সরকার নির্ধারিত সুদের হার না মেনে নানা কৌশলে উচ্চ হারে সুদ ধার্যের অভিযোগ রয়েছে। এতে করে একটা সময় পরে সুদসহ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে একই সঙ্গে কয়েকটি এনজিওর সঙ্গে লেনদেন শুরু করে। ফলে ঋণের পরিমাণ শুধু বাড়তেই থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে টাকার জোগান দিতে ঋণগ্রহীতা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

৩. পৃথক ক্রয় নীতিমালা না থাকা : বাংলাদেশ সরকার যেসব ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে সরকারি ক্রয়নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বেসরকারি সেক্টরে এ ধরনের কোনো পৃথক ক্রয়নীতিমালা নেই। ফলে এনজিওদের পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমের জন্য এটি বিশাল অন্তরায়।

৪. গতানুগতিক কার্যক্রম : বর্তমানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা গতানুগতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না থেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তথা বর্তমানের চাহিদার আলোকে এনজিওদের যুক্ত হওয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ইত্যাদি ক্ষেত্র ছাড়াও সুনির্দিষ্টভাবে শুধু নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও কাজ করার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

৫. দাতা সংস্থার অনাগ্রহ : বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর অনেকেই উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনায় অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। স্বভাবতই বৈদেশিক অনুদান আগের চেয়ে অনেক কমে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেবে। ফলে এই আর্থিক সংকট দক্ষ জনবলের কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।

উত্তরণের উপায় : বিদেশি সংস্থার তহবিলের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করে নিজেদের অর্থায়নের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আয়বর্ধক কার্যক্রমে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণকে একাত্ম করে টেকসই গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যেতে হবে। অন্যদিকে, দেশের এনজিও কর্মকাণ্ডের অবদান বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে এনজিও সেক্টরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে বছরভিত্তিক সেরা এনজিও নির্বাচন করে পুরস্কারের প্রচলন করা উচিত বলে আমি মনে করি।

লেখক : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা

কালীগঞ্জ, গাজীপুর

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close