অলোক আচার্য

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন স্থায়ী শান্তি রক্ষায় দ্বিরাষ্ট্রনীতি

ফিলিস্তিনের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থন বাড়লেও কার্যত ইসরায়েলকে এখনো দমানো যায়নি। প্রতি ঘণ্টায় সেখানে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনে হামলার শত দিন পার হয়েছে। এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের নিহতের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এই সমস্যার সমাধানে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পথ খুঁজছে। যদিও তাতে অগ্রগতি কমই। তবে যেহেতু আবারও এই যুক্তরাষ্ট্র এই প্রস্তাব দিয়েছে যদিও ইসরায়েল তাতে অসম্মতি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরায়েলের অন্যান্য মিত্র দেশ এবং বিপক্ষে থাকা রাষ্ট্রগুলোও ‘দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের’ কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে একটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পাশাপাশি অবস্থানের কথা উল্লেখ আছে। নেতানিয়াহুর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার পরপরই একই দিনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া গাজা পুনর্গঠনের স্বল্পমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করার কোনো উপায় নেই।’ যুক্তরাষ্ট্রের পর এবার ইসরায়েলকে ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ সমাধানে চাপ দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। সম্প্রতি বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে দুপক্ষের শীর্ষ কূটনীতিক এবং প্রধান আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকে গাজা যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি চূড়ান্ত ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ সমাধানের জন্য ইসরায়েলকে চাপপ্রয়োগ করেছেন ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যকার অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে চলা যুদ্ধে প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরীহ ফিলিস্তিনিরা এর নির্মম শিকার হচ্ছে। এই বিরতি সাময়িক নয়, পৃথিবী চায় স্থায়ী সমাধান। স্থায়ী সমাধান না হলে কখনোই এ অঞ্চলে শান্তি ফিরবে না। যুদ্ধ থেকে পৃথিবীকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। যুদ্ধ পৃথিবীকে কিছুই দিতে পারে না কেবল ধ্বংস ছাড়া। শুরু থেকেই ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আত্মরক্ষার অধিকারের নামে যা হচ্ছে, সেটি শুধু আত্মরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন চরম অমানবতার পর্যায়ে গেছে।

মানবতা ফিলিস্তিনে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, শিশুদের জন্য জায়গাটা এখন নরকের থেকে বেশি ভয়াবহ। হামলার এই পর্যায়ে সব দেশই চাইছিল যুদ্ধবিরতি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ব্যাপক অভিযানে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাপিয়ে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং গাজা উপত্যকায় ঘটে চলা তীব্র নৃশংসতা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব যেন যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকেই নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়েছে। মানুষ এতটাই অমানবিক, প্রতিশোধপরায়ণ এবং নিষ্ঠুর হতে পেরেছে যে ফিলিস্তিনের একটি হাসপাতালেও বোমার আঘাতে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে কিন্তু মৃত মানুষও ছিল। একজন মানুষ আর কতবার মরবে? অতি দ্রুত এখন ইসরায়েলের এই নৃশংসতা বন্ধ করা জরুরি এবং বিশ্বকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করে তুলছে। ফলে যুদ্ধ বন্ধে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব আবারও সামনে এসেছে। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান মূলত ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েল নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সহজ ভাষায়, আলাদা আলাদা দুটি সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ ইহুদি জনগণের জন্য ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ফিলিস্তিন। দুটি দেশের মানুষ একে-অন্যের পাশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেটি সমাধানের জন্য দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকেই সবচেয়ে উত্তম মনে করছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অনেক দেশ এতে সমর্থন জানায়। ইসরায়েল ক্ষমতা দখলের পর থেকে গাজায় একের পর এক হামলা চালায়। দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের তত্ত্বটি এসেছিল ১৯৯৩ সালে অসলো শান্তি আলোচনার মাধ্যমে এবং দুপক্ষই তাতে সম্মত হয়েছিল। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান নীতির উৎস মূলত ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ডস চুক্তি (শান্তি চুক্তি)। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েল এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। দুপক্ষই জেরুজালেম শহরকে নিজেদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে। দুদেশের মধ্যে একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজার উদ্দেশ্যেই একটি মডেল দাঁড় করানো হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এ তত্ত্ব বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বিভিন্ন সময় এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। দ্বি-রাষ্ট্র নীতিতে এখনো সমাধান সম্ভব এটা বিশ্বাস করে বেশির ভাগ দেশ ও মানুষ। দুটো আলাদা দেশ হবে এবং আলাদা আলাদা স্বাধীন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এভাবে সমাধান সম্ভব। তা ছাড়া যুদ্ধ চলতেই থাকবে। যদি উভয় পক্ষই এ চুক্তি বা দ্বি-রাষ্ট্র নীতি মেনে চলে তাহলে অমীমাংসিত বিষয়গুলো উভয়ের সম্মতিতে মীমাংসা করা সম্ভব হবে। তবে এটা মেনে চলার আপাতত খুব বেশি সম্ভাবনা নেই।

যুদ্ধ কত দিন চলতে পারে এর উত্তর এ কারণে দেওয়া যায় না, যে কারণগুলো দেখিয়ে সেসব বিষয়ে কীভাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। অথবা কোনো দেশ নিজ উদ্যোগে এই কাজটি করবে সেটিও প্রশ্নের। ফলে যুদ্ধ থামার কোনো আশা দেখছে না বিশ্ব। যত দীর্ঘ সময় নিয়ে যুদ্ধ হবে ততই ক্ষতি বাড়বে। নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। মানুষ তার বেঁচে থাকার আশা হারাবে। নিজেকে একবার সেই জায়গায় ভাবি, যেখানে যুদ্ধাবস্থায় মানুষের দিনরাত চলছে। হয়তো একপক্ষ বিজয়ী হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে যাবে মানবতা অর্থাৎ মানুষ। যুদ্ধ এক আজব বিষয়। মানুষের প্রাণ নিয়ে মানুষের লাভ! লাভণ্ডক্ষতির হিসাবের পাল্লায় ক্ষতির হিসাবটাই অনেক বড়। একটি টেকসই পৃথিবী গঠনে অস্ত্র নয়, প্রয়োজন সবার জন্য খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা। সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হতে প্রথমেই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। আর তা না হলে নিজেদের হাতে তৈরি সভ্যতায় নিজেরাই বিলুপ্ত হবে বলে কোনো সন্দেহ নেই।

ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দ্বি-রাষ্ট্র নীতি উল্লেখযোগ্য সমাধান হতে পারে। কিন্তু ফিলিস্তিন এত সহজে তাদের এই প্রস্তাব মানবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিষয়ে বিশ্বকে একমত হতে হবে এবং তাদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এভাবে আর কত নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটবে, যাদের বেশির ভাগই ফিলিস্তিনি? ইসরায়েলের একের পর এক আক্রমণে ফিলিস্তিনের অনেক এলাকা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কত দিনে ওই অঞ্চলে একটি স্থায়ী সমাধান আসবে সেটাও নিশ্চিত নয়। যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য ছুড়ছে, অন্যদিকে শান্তির বুলি। মানুষ আসলে কী চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যাদের মাথার ওপর ছাদ ছিল। আজ নেই। মানুষের তৈরি অস্ত্র সেই ছাদ ধ্বংস করে দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে আসলে গভীরভাবে ভাবতে হবে যে তারা কি চায়, যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা? এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলা যুদ্ধবিরতি অতীতেও কার্যকরের পর ফের উভয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। অতীতেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনে বিশ্বে দাবি জোরালো হয়েছে। পরিকল্পনা হয়েছে, প্রস্তাব হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুই একটি স্বাধীন ভূমির প্রত্যাশা করে। যুদ্ধ বা হানাহানি জন্ম থেকে প্রত্যাশা করে না। কিন্তু ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া একটি শিশু কেন সেই স্বপ্ন দেখতে পারবে না, এর উত্তর কারো কাছে নেই। ফলে পৃথিবীর স্বার্থে পৌঁছাতে হবে কোনো স্থায়ী সমাধানে। এভাবে পক্ষ-বিপক্ষ একটি বিশ্বযুদ্ধে অথবা ব্যাপক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এর মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সুতরাং পৃথিবীর স্বার্থেই সব ধরনের যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে এবং মানবিক উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা যুদ্ধ বিরতি চাই না, আমরা চাই স্থায়ী সমাধান অর্থাৎ যুদ্ধ বন্ধ হোক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close