মাহেদা তাইয়্যেবা

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

দক্ষ মানবশক্তি তৈরির প্রতিবন্ধকতা দরিদ্রতা

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে উপনীত হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ সরেজমিনে দরিদ্রতা কতটা কমাতে পেরেছে? আপনার বাড়ির আশপাশে যারা ছিল সেদিন মজুর, সেই কৃষক, সেই জেলে তারা কি আদৌ তাদের অবস্থান থেকে উন্নতি করতে পেরেছে? যদি সচিত্রে বাংলাদেশের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয়, তবে হয়তো আমাদের দেশের বেকারত্বের হার এবং দরিদ্রতার হার আরো বাড়বে। কারণ যখন জরিপ করতে গিয়ে বলা হয় আপনার ছেলেমেয়ে কি বেকার? তখন চক্ষু লজ্জা কিংবা লোকলজ্জা থেকে বাঁচতে আমাদের সমাজের অনেক মানুষই বলে না আমি বেকার কিংবা আমার ছেলে বেকার নয়। সে যাই হোক সে প্রসঙ্গে কথা না বলি।

এই প্রজন্মের একজন তরুণী হিসেবে দক্ষ মানবশক্তি তৈরির অভাবকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে হয়। এ ছাড়া সম্পদের অসম বণ্টন, ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যা, কর্মসংস্থান তৈরির অভাব, দুর্নীতির প্রভাব, সামাজিক অসমতা, মানসম্মত শিক্ষার অভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজনীতিকীকরণ, উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ এবং সুযোগের অভাব, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন। এসব বিষয় আসলে চক্রাকারভাবে একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত এবং এই চক্র থেকে একটি উন্নয়শীল দেশ হিসেবে অনেক কঠিন বিষয়। সম্পদের অসম বণ্টন আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয় বরং সমাজের ২০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে ৮০ শতাংশ মানুষের সম্পদ। অন্যদিকে ৮০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে সেই ২০ শতাংশ সম্পদ। আপনি এখানে দরিদ্রতা কমাবেন কীভাবে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করবেন কীভাবে? কারণ আপনার সম্পদের সুযোগ-সুবিধা এবং ভোগ করার জায়গাগুলো ২০ এবং ৮০ শতাংশের মাঝে আটকে আছে। তারপর আসি জনবহুল বাংলাদেশে চিত্রে। ঘনবসতি পূর্ণ এই দেশে কর্মসংস্থান তৈরি এবং বেকারত্ব কমানো আরো বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি দুটোই সহোদর ভাইয়ের মতো।

সামাজিক অসমতা বাংলাদেশের সমাজে নতুন কিছু নয় আমরা এখনো নিজে সরকারি স্কুলের শিক্ষক হলে সন্তানকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠাই শিক্ষাগ্রহণ করতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর কথা যদি বলি এখানে গুণগত শিক্ষার মান কতটা উন্নত তা সবাই জানেন। কে কীভাবে কোথা থেকে পিছিয়ে পড়ছে কিংবা কীভাবে বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লড়বে, সে বিষয়ে জানা নেই। এর কারণ কী হতে পারে? কারণ আমাদের শিক্ষার মানের উন্নতি নেই, শুধু আছে শিক্ষার হারের উন্নতি। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার বেশির ভাগই শিক্ষার্থীরাই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্ররাজনীতি খারাপ কিছু না কিন্তু যারা ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করেন তারা নিজের স্বার্থের জন্য করেন। তারা যদি চায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে চাপ প্রয়োগ করতে পারত? তারা বলতে পারত আমার ক্যাম্পাসে গবেষণাগার নেই, শুদ্ধ জ্ঞানচর্চার জায়গা নেই। আপনারা দেখেন এটা কীভাবে উন্নতি করা যায়। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অন্তত নজরে নিত। ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস বাংলাদেশে পূর্ব থেকেই সমৃদ্ধ এবং গৌরব অর্জন করেছিল, কারণ তারা নিজ স্বার্থ নয় বরং জাতির স্বার্থ এবং গণমানুষের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা একটু হলেও ভিন্নতা দেখি।

এবার আসা যাক উদ্যোক্তা হওয়ার প্রসঙ্গে। আজকে বাংলাদের দরিদ্রতার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থান তৈরির জায়গা এবং উৎসাহের অভাব। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং দরিদ্রতা একে অন্যের সঙ্গে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে জড়িত।

বিশ্বের বড় বড় ধনকুবেরেরা কেউ হার্ভার্ড, এমআইটি কিংবা অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। তারা সবাই উদ্যোক্তা হয়েছে এবং নিজের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। এমনও ধনকুবের আছে যারা এমআইটির সেরা শিক্ষার্থীদের একজন। কিন্তু সে চাকরির পেছনে ছুটেনি। বরং নিজে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং অন্য তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের জন্য জায়গা তৈরি করেছে। আমাজন নিজস্ব পণ্য নিজে ডেলিভারি দেয়। সেখানে ১০ হাজার কিংবা তার অধিক ড্রাইভার নিয়োগ করেছে! এখানে কি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়নি? কেন এগিয়েছে তাদের দেশ এবং সমাজ, কারণ তাদের ইচ্ছের জায়গাকে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ করা হয় আর বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়োগ করা হয় কারণ কি জানেন? তারা চায় ভিন্ন কিছু আসুক ভিন্ন জায়গা থেকে। অর্থাৎ বিশ্বের যত উন্নত দেশ আছে, তাদের উন্নতি করার পেছনে শুধু তাদের দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে নয় বরং তাদের কাজে লাগানো বিষয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের দরিদ্রতার কারণ হিসেবে কিন্তু তরুণ প্রজন্ম শুধু অন্ন-বস্ত্রের অভাবকে বোঝায় না। তারা বোঝায় নানা প্রসঙ্গ এবং সামাজিক বিষয়। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা দরিদ্রতা কথাটিই এখানে ফুটে উঠেছে। কারণ আমরা শিক্ষার হার বাড়িয়েছি মানের উন্নতি না।

একজন দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে আমাদের যেসব বিষয় নজর দেওয়া উচিত তার মধ্যে উল্লিখিত বিষয়গুলো একটি অন্যটির পরিপূরক। সম্পদের অসম বণ্টন থেকে সুসময় বণ্টন দরকার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেসব মানুষকে জনশক্তিতে পরিণত করা দরকার। তবেই আমাদের সমাজ থেকে দরিদ্রতার হার নয় বরং প্রকৃত দরিদ্রের সংখ্যা কমে আসবে এবং দক্ষ মানব তৈরি হবে দেশ এবং সমাজকে সমৃদ্ধ করবে, এগিয়ে যাবে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close