হুমায়ুন কবীর রুস্তম

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

তীব্র শীতে মানবিক বিপর্যয়ে পথশিশুরা

হেমন্তের নিমন্ত্রণে ষড়ঋতুর দেশে শীতের আগমন ঘটেছে অনেক আগেই। শুরুতে শীত স্বস্তির থাকলেও এখন অবস্থা ভয়াবহ। কথায় আছে মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। কিন্তু পৌষেই শীত যে কাঁপুনি তুলেছে তাতে মাঘের অবস্থা যে আরো বেশি ভয়াবহ হতে চলছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শৈত্যপ্রবাহ আর ঘন কুয়াশায় শীতের প্রকটতা বেড়েই চলছে। উত্তরাঞ্চলের অবস্থা আরো বেশি বেগতিক। এই অঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে অবস্থান করে। উষ্ণ কাপড় আর মোটা লেপ-তোশকেও শীতকে মোকাবিলা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবার শীত ধনীদের জন্য আনন্দের হলেও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ধনী থেকে মধ্যবিত্ত উভয়ের কাছেই শীত এখন অস্বস্তিকর বিষয়। যেখানে ধনী আর মধ্যবিত্তদের নাজেহাল অবস্থা, সেখানে বস্ত্রহীন নিম্নবিত্ত আর পথশিশুদের কি অবস্থা ভেবে দেখেছেন কখনো?

ঢাকা শহরের ফুটপাত কিংবা রেললাইনে পথশিশুদের দেখা মেলে। কেউ পরিবার থেকে বঞ্চিত, কারো মা-বাবা বিকলাঙ্গ, কেউবা পরিচয়হীন। এই শিশুদের বসবাসের জন্য ব্যক্তিগত কোনো ঘরবাড়ি নেই। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত- এরা পথেই কাটিয়ে দেয়। পথেই এদের বসবাস, পথ থেকেই এদের জীবিকা নির্বাহ হয়। অর্থ সাহায্য, ফুল বা খেলনা বিক্রি কিংবা ধনীদের গাড়ি পরিষ্কার করা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। যার পরিমাণটা অতি নগণ্য। এ অর্থে দিনে এক থেকে দুবেলা খাবার জোটে। কখনো কখনো সারাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দেয়।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য মতে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। আর বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু ঢাকাতেই ৬ লাখ পথশিশু রয়েছে। যারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঢাকার বাইরেরও একই অবস্থা বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের পথশিশুদের অবস্থা আরো বেশি ভয়াবহ। কারণ দেশের সব থেকে বেশি শীত অনুভূত হয় উত্তরাঞ্চলে। হিমালয়ের নিকটবর্তী অংশ হওয়ায় এখানে শীতের প্রকটতা অনেক বেশি। হিমালয়কন্যার নিঃশ্বাস ভেসে এসে হিম করে দেয় উত্তরের হাওয়া আর তাতেই শুরু হয় হাড় কাঁপানো শীত। ২০১৮ সালে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। উত্তরাঞ্চলের ছিন্নমূল মানুষ শীত থেকে রক্ষায় খড়-কাঠ পুড়িয়ে তাপ শোষণের চেষ্টা করে। কিন্তু এই তাপ হাড় কাঁপানো শীতের জন্য যথেষ্ট নয়।

অতিরিক্ত শীতের কারণে জ্বর, সর্দি-কাঁশি থেকে শুরু করে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এই শিশুরা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সেবা দেওয়ার মতো কেউ নেই। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, এই শিশুদের জন্য আলাদা কোনো স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোতেও এরা তিরস্কারের শিকার হয়। ফলে প্রকৃত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয় পথেই। সরকারিভাবে পথশিশুদের রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ঠিকই কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং দুর্নীতির কবলে অনেক পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হয় না। ছিন্নমূল মানুষদের জন্য বরাদ্দ করা অংশ ওপর মহলেই বণ্টন হয়ে যায়। বাকি যা দেওয়া হয় তা নামমাত্র ছাড়া আর কিছুই না। প্রতিবার দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শীতবস্ত্র কর্মসূচির আয়োজন করতে দেখা যেত; কিন্তু এবার সেই চিত্র চোখে পড়ছে না। দেশের কিছু যুবসমাজ ও স্বেচ্ছাচারী সংগঠনের উদ্যোগে শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেলেও তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তাই এই বিশাল সংখ্যার পথশিশুর জীবন রক্ষায় আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। স্ব-উদ্যোগে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে দাঁড়াতে হবে।

আক্ষরিক অর্থে ২০ কোটির মানুষের দেশে ১০ লাখ পথশিশুর জীবন রক্ষা করা কোনো কঠিন কাজ নয়। কয়েকজন স্বাবলম্বী মানুষ যদি একটি পথশিশুর পাশে দাঁড়ায় তাহলে অতি সহজেই পথশিশুদের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব। সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের মানবিক হতে হবে। ছিন্নমূলের বরাদ্দ যেন সঠিকভাবে বণ্টন হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে পথশিশুদের আবাসনের ব্যবস্থা অতীব জরুরি। পরিশেষে একটি লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই, মানুষের জন্মই মানবসেবার জন্য আর মানবসেবার মতো শান্তির অনুভূতি আর কোনো কিছুতে নেই।

লেখক : শিক্ষার্থী-গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close