ইসরাত জাহান

  ২০ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

তরুণসমাজ কেন বিদেশমুখী

বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, মিলছে না কর্মসংস্থান। মেধার সঠিক বিচার বা জ্ঞানের সঠিক ইউটিলাইজেশনও হচ্ছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। ঠিক কত শিক্ষার্থী বিদেশে যান তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। দূতাবাসগুলোতেও এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। তবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত জব সিকিউরিটি, সোশ্যাল ডিমান্ড, ইকোনমিক্যাল স্টাবিলিটিসহ বেশ কিছু কারণে তারা দেশ ছাড়েন। আর ডিগ্রি গ্রহণের পর দেশে না ফেরার কারণ হচ্ছে, দেশে যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া। কারণ একজন ডিগ্রিধারী দেশে ফিরে তার এক্সপেক্টেশন অনুযায়ী চাকরি পান না। পেলেও যথাযথ মূল্যায়ন পান না। তাই তারা দেশে ফিরতে আগ্রহী নন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গ্লোবাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মধ্যে থাকতে হবে। কেউ বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে তাতে দেশেরই লাভ। আবার তাদের কীভাবে দেশে কাজে লাগানো যায় তাও ভাবতে হবে। তাহলে দেশের ইকোনমিসহ সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি সম্ভব। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে।

ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেওয়া ৪৯ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত গেছেন ১১ হাজার ১৫৭ জন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ৮ হাজার ৬৬৫, মালয়েশিয়ায় ৬ হাজার ১৮০, অস্ট্রেলিয়ায় ৫ হাজার ৬৪৭, কানাডায় ৫ হাজার ১৩৬, জার্মানিতে ৩ হাজার ৯৩০, যুক্তরাজ্যে ৩ হাজার ১৯৪, জাপানে ২ হাজার ৮০২, ভারতে ২ হাজার ৭৫০ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১ হাজার ১৭৬ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাজ্যের টিসাইড ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত এইচ এম ইমরান হোসাইন বলেন, আমাদের সোশ্যাল কাইটেরিয়া হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ছে মানে তাকে বিসিএস বা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি পেতে হবে। কিন্তু চাইলেই সবাই সরকারি চাকরি পায় না। অনেকের আবার এর প্রতি আগ্রহও নেই। অন্যদিকে প্রাইভেট সেক্টরে জব সিকিউরিটি নেই। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমান। তা ছাড়া লাইফ সিকিউরিটি বলতে একটি বিষয় তো থাকে। ডেভেলপড? কোনো কান্ট্রিতে সেটেল্ড হতে পারলে পরবর্তী প্রজন্ম সিকিউরড একটা লাইফ লিভ করবে- এমনটাও ধারণা অনেকের। দেশে ফেরত না আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশে ফিরলে একজন শিক্ষার্থীর যে মেধা রয়েছে তার সঠিক ইউটিলাইজ করার সুযোগ কম। পক্ষান্তরে বিদেশে সেটেল্ড হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারা আমি মনে করি দোষের না। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে বলেই রেমিট্যান্স পাঠায়। উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশে ভালো একটি জব করে রেমিট্যান্স পাঠানো দেশের অর্থনীতির জন্য বেশি কার্যকর বলে মনে করি।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটনের পিএইচডি গবেষক সোহানা ভূঁইয়া বলেন, মেধাবীদের দেশ ছাড়ার অন্যতম কারণ টক্সিক সোশ্যাল কমিউনিটি। একজন মেয়ে হয়ে আমি দেখেছি গ্রাম থেকে শহরে সব জায়গায় পরিবেশটা টক্সিক করে রাখা হয়েছে। সবার কাছে বিয়ে সরকারি চাকরি মুখ্য বিষয়। তাই আমি এসব স্টিগমা থেকে বের হতে চেয়েছি। এ ছাড়া জব সিকিউরিটি, জীবনমান, আশপাশের পরিবেশসহ মৌলিক বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। আমাদের সোশ্যাল স্ট্রাকচার, জব কালচার, ইকোনমিক কালচার সব অসহনীয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের সামাজিক স্ট্রাকচারে সাকসেস বলতে কেবল বিসিএস বা প্রথম শ্রেণির জবকে বোঝায়। সেখানে অন্যান্য জবও যে আইডল হতে পারে তা কেউ মানতে চায় না। এমনকি সেটা বোঝানোও মুশকিল। এর কিছু বাস্তবতাও রয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরে জব সিকিউরিটি কিংবা ফিন্যান্সিয়াল সিকিউরিটির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আর যখন কারো পরিবেশ এ রকম টক্সিক হয়ে যায় তখন সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, তরুণদের কর্মের স্বাধীনতাও থাকা উচিত। বিসিএস ক্যাডার কিংবা প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি করেও সবাই সুখী না- এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর দেশে না ফেরার কারণ হচ্ছে দেশে ফিরে যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়া। দেশে ফিরলে অবিজ্ঞতা অনুযায়ী একটি চাকরি পাওয়া কঠিন। তাই দেশে ফিরতে চায় না অনেকে।

সাউথ কোরিয়ার আজু ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত মীর লোকমান বলেন, আর্থসামাজিক কারণে মেধাবীরা দেশ ছাড়ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সব প্রেক্ষাপটই এর সঙ্গে যুক্ত। যারা দেশ ছাড়ছেন তারা এসব ক্ষেত্রে নিজেদের ইনসিকিউরড মনে করেন। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন বলেই দেশ ছাড়ছেন। তিনি বলেন, আমাদের মেধাবীরা দেশকে অনেক কিছু দিতে চায়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফেরার আগে ভাবে সেখানে সে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সিকিউরড থাকতে পারবে কি না। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে ফিরলে যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র পায় না।

মেধাবী তরুণদের দেশে রাখতে হলে তৈরি করতে হবে বিপুল কর্মসংস্থান, দিতে হবে তাদের মেধা বিকাশের সঠিক ফিল্ড, দক্ষতা বিবেচনায় কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, তবেই তরুণসমাজকে দেশমুখী করা সম্ভব হবে, নয়তো তারা দেশের প্রত্যাশা ছেড়ে পাড়ি জমাবে ভিন্ন রাষ্ট্রে। দেশের মেধাবী তরুণরাই দেশের মেরুদণ্ড। তারা মনোযোগ দিলে দেশ তৈরি হতে পারে নতুন আঙ্গিকে। আজকের তরুণ আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাই তরুণদের দেশমুখী করা জরুরি।

লেখক : লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close