রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২০ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শীতার্তকে উষ্ণতা দিতে পারে আপনার সহানুভূতি

প্রতি বছর শীতকাল আমাদের মাঝে আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু কষ্ট হয় অসহায় ও দুঃখী মানুষের। বর্ষা ও শীতকাল। এ দুটো কালেই অসহায় মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভোগে। যৎসামান্য যে সাহায্য তারা পায়, তা দিয়ে কোনোভাবেই তাদের কুলোয় না। কষ্ট সহ্য করেই দিন পার করতে হয়। হাড় কাঁপানো শীতের হাত থেকে বাঁচাতে অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য আপনিও কিছু করুন। আপনার পুরোনো জামা-কাপড় যেগুলো হয়তো আপনার কোনো কাজেই লাগছে না। সেসব জামা-কাপড়ই এখন হয়তো একজন রাস্তার মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। তাদের প্রতি একটু সদয় হোন! ঋতু পরিক্রমায় বাংলা পৌষ ও মাঘ শীতকাল। ষড়ঋতুর এই দেশে এখন আর ষড়ঋতু নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শীত, গরম ও বর্ষা এই তিন ঋতুরই প্রভাব। প্রচণ্ড গরম, অতিমাত্রায় শীত ও অতিবৃষ্টির প্রভাব বেশি। ষড়ঋতুতে বাংলা পৌষ ও মাঘ শীতকাল হলেও কোনো কোনো বছর কার্তিকের শেষদিক থেকে শীত শুরু হয় এবং তা থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং এর মাত্রা নিচে নেমে আসে। তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ শীত অনেক সময় হাড় কাঁপানো শীতে পরিণত হয়। এ বছর শীত অনেক পরে এসেছে। পৌষ মাসের শেষদিকে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের তীব্রতা বেড়ে গেছে। সারা দেশে এখন হাড় কাঁপানো শীত। এই শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেয়ে উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা তিন-চার গুণ বেশি। এখন পুরোদমে চলছে শীতকাল। নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে শুরু করেছে। গরম কাপড়ের অভাবে অসহায় মানুষগুলো রাতে ঘুমাতে পারে না। সমাজের উঁচুস্তরের মানুষজন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে একটু মমতার দৃষ্টি দিলে তারা একটু আরামে ঘুমাতে পারে।

শীতার্ত মানুষগুলো কতটা দুর্বিষহ জীবনযাপন করে। তা শহর-নগরের ফুটপাত, রেলস্টেশনে না গেলে বোঝা মুশকিল। শীতে এখন কাঁপছে গোটা দেশ। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় সারা দেশে শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ দেশ হলেও বছরের শেষের দিকে এ দেশে শীতের প্রকোপটা বাড়তে শুরু করে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত হাড় কাঁপানো শীতে স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং হ্রাস ঘটে। তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। তখন ভোগান্তিতে পড়ে গরিব-দুঃখী লোকজন। বিশেষত যাদের শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে অভাবী ও গরিব মানুষ। এর পাশাপাশি বাড়ে ঠাণ্ডাজনিত রোগব্যাধি। সবচেয়ে বেশি কষ্টে পড়ে শিশু, নারী, প্রতিবন্ধী ও বয়স্করা। তারা সর্দি-কাশি, হাঁপানিসহ ফুসফুসজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগে। কনকনে ঠাণ্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের জনজীবন। শীত এলে অনিবার্যভাবেই প্রকৃতিতে ঘটে কিছু পরিবর্তন। হেমন্তের ফসল কাটা শেষ হয়। নবান্নের সঙ্গে পিঠাণ্ডপায়েসের আয়োজন চলে গ্রামাঞ্চলে। শীত একদিকে যেমন উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। অন্যদিকে তীব্র শীত জীবনযাত্রা বিপন্ন করে তোলে মানুষ জনের। বিশেষ করে দরিদ্ররা শীতের কাপড়ের অভাবে কষ্ট পায়। শীতকাল কারো কারো জন্য আনন্দের বিষয় আবার কারো জন্য বিষাদের। শীত মানেই কুয়াশা-মোড়ানো ভোরে চুলোর পাশে বসে পিঠা খাওয়া। গল্পের আসরে বসে ধূমায়িত চা-কফির উষ্ণ স্বাদ। দীর্ঘ রাতে লেপ-কম্বলের ওম লাভের আনন্দ। কিন্তু যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের জন্য শীত মানে ভয়াবহ দুঃসংবাদ। শীতকাল বিত্তবানদের জন্য বিলাসিতায় কাটানোর ঋতু হলেও, দরিদ্রদের জন্য পরিলক্ষিত হয় ভিন্ন চিত্র। শীতকাল যেমন দুহাত ভরে প্রকৃতিকে উপহার দেয়, তেমনি প্রকৃতি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় শত শত মানুষের প্রাণ।

পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে তাদের কাছে এই ঋতু হয়ে ওঠে মৃত্যুযন্ত্রণার সমতুল্য। তীব্র শীত দেখিয়ে যায় তার নিষ্ঠুর রূপ। সড়কের পাশে, বাস ও ট্রেন স্টেশনে, বাজার-ঘাটে রাতের বেলা এমন অনেক অসহায় মানুষকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের রাত কাটে নির্ঘুম অবস্থায় শীতের প্রকোপে জবুথবু হয়ে। ঋতুর আবর্তনে শীত আসবে, এটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে খাপ খেয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তবে তীব্র শীতে গরিব ও দুস্থ মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়। সমাজের অসহায় ও শীতার্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবারই নৈতিক দায়িত্ব। জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে পড়ে দিনমজুর, ভ্যানচালক, ইজিবাইক চালক, পাথর শ্রমিক, চা-শ্রমিকসহ সাধারণ কর্মজীবী এবং ছিন্নমূল মানুষের। খেটে খাওয়া মানুষরা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাজে যোগ দিতে দুর্ভোগে পড়ছেন। তাদের প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে কষ্ট হচ্ছে বেশি। তাই সমাজের বিত্তবান ও মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন। তাই সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি থেকে শীতার্তদের রক্ষা করা যায়। দরিদ্র মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানবসেবা। অসহায়দের সাহায্যের মাধ্যমেই তৈরি হবে মানবিক সেতুবন্ধ। আমাদের সামান্য সহযোগিতায় শীতার্ত মানুষরা সুস্থ ও ভালো থাকতে পারবে। কনকনে শীতে শীতবস্ত্র তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। এর মাধ্যমে প্রকাশ পাবে মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। শীতে কর্মজীবী মানুষ খুব কষ্ট পায়। কুয়াশা আর ঠাণ্ডার মধ্যেও জীবিকার সন্ধানে সবকিছু অতিক্রম করে তাদের কাজে নামতে হয় দুমুঠো ভাতের জন্য। শীতের সময় বিভিন্ন জায়গায় শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। কিছুটা হলেও শীতার্ত মানুষ স্বস্তি লাভ করে গরম কাপড় পেয়ে।

সরকারিভাবে অনেক সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে শীতবস্ত্র দেওয়া হয়। আবার কখনো সরকারদলীয় নেতাদের মাধ্যমে আসে। শীতে যে কাপড় শীতার্ত গরিব মানুষ পাবে বলে ধারণা করা হয়, অনেক সময় ঘটে তার উল্টো। যাদের কম্বল বিতরণ করতে দেওয়া হয়, তাদের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় শীতবস্ত্র সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। আবার কোথাও কোথাও শীতবস্ত্র বিতরণে দলীয়করণও লক্ষ করা যায়, যা মোটেও কাম্য নহে। প্রতি বছর শীত এলে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানোর কথা উচ্চারিত হয়। সমাজের সামর্থ্যবান জনদরদি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কম্বল ও শীতবস্ত্র দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। যুবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করে এবং তা গরিবদের মধ্যে বণ্টন করেন। শীত এলে এসব ছিল চিরচেনা সামাজিক কর্মকাণ্ড। এই হাড় কাঁপানো শীতে যে বিপুল জনগোষ্ঠী বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে, তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার দায়িত্ব। আমাদের নিজেদের অতিরিক্ত থাকা শীতবস্ত্র থেকে একটি বা দুটি শীতার্তদের দিলে হতদরিদ্র মানুষগুলো একটু উষ্ণতায় স্বস্তি পাবে। শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে প্রতি বছর বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে আসে। কিন্তু শুধু সংগঠন দিয়ে এ উদ্দেশ্য সফল করা খুব কষ্টকর। কারণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর আয়ের তেমন কোনো উৎস নেই। তাই আমরা প্রত্যেকে যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসি, দিনশেষে একটি বৃদ্ধ মানুষ বা শিশুকে সাহায্য করি নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী, তবে অনেকাংশে শীতবস্ত্রহীনতার কষ্ট লাঘব হবে। শুধু সরকার নয়, দেশের প্রতিটি নাগরিক যদি সাহায্যের হাত বাড়ায়, তবে হাসি

ফুটবে অসহায় মানুষের মুখে, বাঁচবে জীবন। প্রয়োজন একটু মানবিক হওয়া।

প্রকৃতির পরিবর্তন ও বিরূপ প্রভাব মহান সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। প্রকৃতির নিয়মে ঋতুর পরিবর্তন হবে। এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য প্রতিটি ঋতুই যেন উপভোগ করা যায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি। শীতজনিত রোগব্যাধি থেকে মানুষজনকে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তীব্র শীতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সে জন্য গরম কাপড় সরবরাহ করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু সরকার নয় সমাজের বিত্তবানরা এ জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। অনেক সংগঠন এ সময় নতুন-পুরাতন কাপড় সংগ্রহ করে শীতার্তদের মাঝে বিতরণ করে। এই মানবিক কর্মে আমরাও যুক্ত হতে পারি। এই সহায়তা হতে পারে আর্থিক, হতে পারে মানবিক বা সহমর্মিতা প্রদর্শন। প্রতি বছর বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ প্রচণ্ড শীতের সময় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটায়। এদের যেখানে এক বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, তারা কীভাবে শীতবস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। তা ছাড়া শীতকাল শুরু হলেই গরিব-দুঃখী অসহায় মানুষের শীতজনিত রোগ বেড়ে যায়। এসব মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা অনেক বড় ইবাদত। সমাজের বিত্তবান মানুষের সম্পদে অসহায় গরিবদের হক রয়েছে। এই বঞ্চিতদের দান করা কোনো করুণা বা দয়া নয়। এটি বিত্তবানদের কর্তব্য। বিত্তবানরা শীতবস্ত্র ব্যবহার করে শীত থেকে রেহাই পেলেও দরিদ্ররা শীতবস্ত্রের অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট করে মানবেতর জীবনযাপন করে। সচ্ছল মানুষ একটু সচেতন হলে হতদরিদ্র মানুষের সাহায্যের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তিলাভ করা সম্ভব। আসুন আমরা সবাই নিঃস্বার্থভাবে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসি।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close