এ কে এম এ হামিদ

  ১৮ জানুয়ারি, ২০২৪

বিশ্লেষণ

জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবনের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা

বিজ্ঞানীদের মতে, প্রায় ১৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের ফলে আবির্ভূত হয় শক্তি, পদার্থ সময় ও স্থান। প্রায় ৩৮০ কোটি বছর আগে পৃথিবী নামক একটি গ্রহে নির্দিষ্ট অণু মিলে জীবন নামের বেশ বড়সড় ও যৌগিক কাঠামো তৈরি হতে শুরু করে। আজ থেকে প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ইতিহাসের চাকা ঘোরাতে শুরু করে। প্রায় ১২-১৩ হাজার বছর আগে শুরু হওয়া কৃষিবিপ্লব এই গতিকে ত্বরান্বিত করে। আর মাত্র ৫০০ বছর আগে শুরু হওয়া বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হয়তো চলমান ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটিয়ে আগামীতে আবির্ভাব ঘটাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর।

প্রাণিজগৎ বা জীবজগতের মধ্যে মানুষের শীর্ষস্থান দখলের পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখে আগুনের আবিষ্কার ও আগুনকে বশে রাখার দক্ষতা। আগুনের ব্যবহার মানুষকে আর অন্য প্রাণীদের মধ্যে বিশাল ব্যবধানের সৃষ্টি করেছে। কেননা অন্য প্রায় সব প্রাণীরই শক্তি নির্ভর করে, তার শক্তি-সামর্থ্যরে ওপর। তাই আগুনের আবিষ্কার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই মানুষের উদ্ভাবনী সক্ষমতার প্রথম প্রকাশ।

মানবজাতির আদিকাল থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভিত্তি করেই সভ্যতার ক্রমবিকাশ বা উত্তরণ ঘটেছে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের অগ্রগতি অগ্রগমনের ইতিহাসই সভ্যতা বিকাশের ইতিহাস। মানুষের মেধা-মননের উদ্ভাবনী জ্ঞান প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জীবন, জীবিকা ও অগ্রগমনে প্রযুক্তি ধাপে ধাপে উন্নত থেকে উন্নতর হয়েছে; আর এই উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে মানবসভ্যতা। সংগতই প্রশ্ন এসে যায়, উদ্ভাবন কী? উদ্ভাবন সম্পর্কে বিশ্বের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিশ্লেষক বিভিন্ন আঙ্গিকে ধারণা দিয়েছেন। যেমন অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পেটারের মতে, উদ্ভাবন হলো সৃজনশীল ধ্বংস, যা ক্রমাগত অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর থেকে বিপ্লব ঘটায় এবং ক্রমাগত পুরোনোটিকে ধ্বংস করে অবিরামভাবে নতুন কিছু তৈরি করে। ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট পিটার ড্রাকারের মতে, উদ্ভাবন হলো উদ্যোক্তার সুনির্দিষ্ট যন্ত্র, যা সম্পদ সৃষ্টির জন্য একটি নতুন ক্ষমতা দিয়ে সম্পদ সৃষ্টি করে। অধ্যাপক ক্লেটন ক্রিস্টেনসেনের মতে, উদ্ভাবন শুধু নতুন প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যা বাজারে গ্রাহকদের দ্বারা গৃহীত পণ্য বা পরিষেবা তৈরি করতে বিভিন্ন উদ্ভাবনকে একত্র করে। পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের মতে, বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত চিহ্ন জ্ঞান নয়, কল্পনা। উদ্ভাবন হলো সমস্যার সমাধান এবং নতুন সম্ভাবনা তৈরি করার জন্য কল্পনা প্রয়োগের ফল। অর্থনীতিবিদ কার্লোটা পেরেজের মতে, উদ্ভাবন শুধু প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি একটি সামাজিক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো ও সমাজ যেভাবে তার সমস্যাগুলো সমাধান করতে এবং একটি ভালো ভবিষ্যৎ তৈরি করতে নিজেকে সংগঠিত করে। এই সংজ্ঞাগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল প্রকৃতির ওপর জোর দেয়।

বর্ণিত ধারণা থেকে এটি স্পষ্ট, উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন কিছু প্রবর্তন বা বিদ্যমান ধারণা, পণ্য বা প্রক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করার প্রক্রিয়া। উদ্ভাবন (ইনোভেশন), সৃজন (ইনভেনশন) এবং আবিষ্কার (ডিসকভার) এই তিনটি ধারণাকে সামগ্রিকভাবে উদ্ভাবন হিসেবে গণ্য করা হলেও প্রকৃত অর্থে পার্থক্য অনেক। তবে তিনটি ধারণাই আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পৃথক অর্থে বিশ্লেষণ করলে এটি স্পষ্ট, উদ্ভাবন-দক্ষতা উন্নত করে, নতুন বাজার তৈরি করে এবং বিদ্যমান পণ্য বা পরিষেবাগুলোকে উন্নত করে অগ্রগতি নিশ্চিত করে। অন্যদিকে সৃজন বা সৃষ্টি সম্পূর্ণ নতুন ধারণা বা সমস্যার সমাধান করে। আবিষ্কার মানুষের জ্ঞানের ভিত্তি প্রসারিত করে উদ্ভাবন ও সৃজন উভয়ের ভিত্তি দেয়। মোটা দাগে বলা যায়, উপাদানগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সমন্বয়মূলক সংমিশ্রণে সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটায়। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবন প্রায়ই সৃজন ও আবিষ্কারের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করে এবং ধারণাগুলোকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য ব্যবহারিক প্রয়োগের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

উদ্ভাবন একটি বহুমুখী ধারণা। ক্ষেত্রবিশেষ বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে। তাই বিভিন্ন মানদ-ের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনকে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। তবে সাধারণভাবে উদ্ভাবনকে ৪টি শ্রেণিকরণে বিভক্ত করা যায়। ১. পণ্য উদ্ভাবন : যা নতুন পণ্য এবং পরিষেবা তৈরি বা উন্নত করা। যার মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে সম্পূর্ণ অফার হিসেবে উপস্থাপন করা।

২. প্রসেস বা প্রক্রিয়া উদ্ভাবন : যা পণ্য উৎপাদন ও পরিষেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং সিস্টেমগুলোকে উন্নত করার ফোকাস করে। যার লক্ষ্য বর্ধিত দক্ষতা, উৎপাদন খরচ হ্রাস এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।

৩. সাংগঠনিক উদ্ভাবন : যা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কার্যকারিতা ও অভিযোজন যোগ্যতাকে উন্নত করতে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, ব্যবস্থাপনা অনুশীলন ও ব্যবসায়িক মডেল পরিবর্তনকে বোঝায়।

৪. বিপনন উদ্ভাবন : যা পণ্য বা পরিষেবার বর্তমান অবস্থান ও বিপণনের পরিবর্তন করে মার্কেটের ক্ষেত্রে নির্ধারিত গ্রাহকের ভিত্তি করে নতুন বিতরণ ও বিপণন পদ্ধতি প্রবর্তন এবং নতুন বাজার খোঁজা ও বিপণন কৌশল অবলম্বনে উৎসাহিত করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক চাহিদার ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট মিশ্রণ পরিবর্তিত হতে পারে। উদ্ভাবনের জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হলে উন্নয়নকে শুধু দ্রুতই নয় বরং তা টেকসই এবং সুসংহত হবে।

দেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করা হবে? পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ তরুণ-তরুণী কর্মে প্রবেশে সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে অব্যাহতভাবে বিশাল বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে বেকারত্ব হ্রাস করতে হলে অবশ্যই পরিকল্পিতভাবে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সরকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। উদ্যোক্তা বিকাশ ও উন্নয়নে উদ্ভাবন মূল ভূমিকা পালন করতে পারে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উদ্ভাবনই সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে, যার মধ্যে উল্লেখ্য- ক. উদ্ভাবন হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা, নতুন শিল্পের বিকাশকে উৎসাহিত করে এবং সামগ্রিক সম্প্রসারণ অবদান রাখে। খ. উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যার ফলে সম্পদের আরো দক্ষ ব্যবহার এবং অর্থনৈতিক আউটপুট বৃদ্ধি পায়। গ. উদ্ভাবন প্রায়ই নতুন ব্যবসা ও শিল্পের সৃষ্টি করে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং বেকারত্বের হার কমায়। ঘ. যে অর্থনীতি উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দেয়, তা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের আকর্ষণ করে। ঙ. উদ্ভাবন টেকসই অনুশীলনের বিকাশ, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে। চ. একটি উদ্ভাবনী পরিবেশ উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত করে, স্টার্টআপ এবং ছোট ব্যবসার বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। ছ. জীবনের মান উন্নয়নে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন নাগরিকদের জীবনের সামগ্রিক মান উন্নত করতে পারে, সামাজিক কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। জ. অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্ভাবন করে, যেমন পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝ. নতুন ও উদ্ভাবনী পণ্য বা পরিষেবাগুলো রাজস্ব স্ট্রিম তৈরি করতে পারে, কর ও অন্যান্য ট্যাক্স আদায়ের মাধ্যমে সরকারি রাজস্বে অবদান রাখতে পারে। ঞ. পরিবর্তনের সঙ্গে উদ্ভাবনী অর্থনীতিগুলো দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিস্থাপকতা এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আরো ভালোভাবে সজ্জিত।

উদ্ভাবন বিষয়ে উপসংহারে এভাবে বলা যায়, সমসাময়িক বিশ্বে সমৃদ্ধির জন্য উদ্ভাবনের অপরিহার্যতা বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। যে জাতি উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেয় এবং অগ্রাধিকার দেয়, তারা তাদের নিজস্ব সাফল্যের স্থপতি। সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করে, পরিবর্তনকে সাদরে আলিঙ্গন করে এবং মানুষের বুদ্ধমত্তার শক্তিকে কাজে লাগায়, এমন একটি সংস্কৃতিকে লালন করে যে সমাজ, সেই সমাজই আজকের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করে সঠিক পথে পরিচালনা বা নেভিগেট করতে পারে এবং একটি সমৃদ্ধ আগামীর ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।

লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও সভাপতি, আইডিইবি

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close