মোতাহার হোসেন

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪

মতামত

শেখ হাসিনার সরকারের সামনে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এবং সরকার পরিবর্তনে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আবার এই নির্বাচন ঘিরে চলে উৎসব ও আনন্দ। বিশেষ করে এবার নতুন ভোটারদের মধ্যে ছিল ব্যাপক উৎসাহ, ছিল টান টান উত্তেজনা। আবার আশঙ্কা উদ্বেগও ছিল। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে সাধারণ নির্বাচন ঘিরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে এবারের নির্বাচনে কয়েকটি দল অংশ না নিয়ে বর্জনের কর্মসূচি দেওয়ায় অস্থিরতা ও অরাজকতার আশঙ্কা ছিল। এমনি অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করাটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সরকার, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা ও বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে সেই আশঙ্কা দূর হয়ে একটি সুষ্ঠুু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার পেল দেশবাসী। প্রধানত যে দলটি এই নির্বাচন বর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বরের আগে সেই দলটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন সব ঘটনা ঘটে, যখন নতুন নতুন দলের আবির্ভাব হয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই এটা কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নির্বাচনও হয়েছে, যখন একটি দল বাদে বাকি সব দল নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ২৮টি দলের ১৯৭০ জন প্রার্থী ৩০০টি আসনে নির্বাচিত হওয়ার মানসে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। শান্তিপূর্ণ এই নির্বাচনে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক নৌকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ২২৩টিতে, স্বতন্ত্র ৬২, জাতীয় পার্টি ১১ এবং অন্যান্য দল জিতেছে ৩টি আসনে। সুতরাং এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

নির্বাচন হচ্ছে মানুষের কাছে রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের একমাত্র উপায়। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, সরকার পাঁচ বছরে মানুষের জন্য কী করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত ১৫ বছরে মানুষ কী পেল, তারও পরীক্ষার সুযোগ পাওয়া গেল নির্বাচনে। নির্বাচন না হলে অসাংবিধানিক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দখলে ঝুঁকি থাকে, (নিকট অতীতে এক-এগারোর সরকারি ছিল অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক সরকার)। এমনকি জনগণের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, উন্নয়ন তথা ভাগ্যের পরিবর্তনও বিঘ্নিত হয়। সেই অবস্থায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পরিত্যাগ করে সম্প্রীতির রাজনীতি জরুরি। কারণ, উন্নয়নের পূর্ব শর্তই হচ্ছে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্য।

অবশেষে সম্পন্ন হয়েছে বহুল আলোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। গত ৭ জানুয়ারি রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সারা দেশে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৯টিতে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। একজন প্রার্থীর মৃত্যুতে নওগাঁ-২ আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪৪। এর মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেয় ২৮টি রাজনৈতিক দল। বিএনপিসহ নিবন্ধিত কিছু দল নির্বাচন বর্জন করেছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার। যদিও ভোট চলাকালে চট্টগ্রামে গুলির ঘটনা ঘটেছে। আর মুন্সীগঞ্জে একজনকে কুপিয়ে হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রকাশ্য ব্যালটে সিল মারা, কোথাও সিল মারা ব্যালট জব্দ ও পরে বাতিলের মতো কিছু ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাঙালি বরাবরই উৎসবপ্রিয় জাতি। বিশেষ করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য উৎসবে দলমত-নির্বিশেষে সব গোত্রের মানুষ একত্রে শামিল হয়ে আনন্দ উপভোগ করে। ঠিক একইভাবে দেশে ৫ বছর পরপর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার প্রয়োগের জন্য মুখিয়ে থাকেন। এ ছাড়া ভোটাধিকার প্রয়োগ প্রতিটি বয়স প্রাপ্ত নাগরিকের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। কারণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্বাচিত করার সুয়োগ পান। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন কিংবা সরকার পরিবর্তনের এই ব্যবস্থা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে এই প্রথা চালু আছে।

এবারের ভোটে প্রধানতম দল ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এশিয়ার প্রাচীনতম এই দলটি জাতির সব অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল হাশেম, মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের একপর্যায়ে নেতৃত্ব নেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং বাঙালি জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে চলবে। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ক্ষমতালোভী ও স্বাধীনতাবিরোধী উচ্চাভিলাসী কিছু উগ্র সেনা সদস্য কর্তৃক সপরিবারে শাহাদতবরণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন নস্যাৎ করা হয়। এরপর অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পায়। তারপর ২০০৯ থেকে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চারবার রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত স্বপ্নের ঠিকানায় উন্নীত করেন তিনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কেন এ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে তাদের রায় দিলেন, তার বিশ্লেষণ দরকার। প্রথমে আসে নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্বের অনন্য স্থাপনা পদ্মা সেতু নির্মাণ। পর্যায়ক্রমে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা থেকে কক্সবাজারের মধ্যে ট্রেন চালু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালীতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, এক শ ইপেজেড নির্মাণসহ প্রায় দেড় ডজন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ‘বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে’ পরিণত হয়েছে। তাই উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে আরেকবার জনসেবার সুযোগ দিতে দেশবাসীকে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আমার ওপর ভরসা রাখুন। আসুন, সবাই মিলে এই বাংলাদেশকে স্মার্ট সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলি। জাতির পিতার স্বপ্নপূরণ করি।

২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে ধারণ করে দেশ পরিচালনায় যে সাফল্য আওয়ামী লীগ দেখিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সাল থেকে স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তোলার ইশতেহার ঘোষণা করেছে। ইতিমধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি টেকসই ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে কার্যকর করা জরুরি। তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জও অনেক এবং বহুমুখী। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম দ্রুত টানা, শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত দেশে আনা, অর্থ পাচার রোধ করা, দেশে রাজপথে থাকা বিরোধেী দলগুলোর আন্দোলন মোকাবিলা, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোকে আস্থায় আনা নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রত্যাশা থাকবে, এসব চ্যালেঞ্জ সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নতসমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সম্ভাবনাময় বিশাল তরুণসমাজকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সহায়ক হবে। কারণ তরুণরাই হচ্ছে মূল কারিগর এবং তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি। প্রত্যাশা, দেশে উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে মানুষ শেখ হাসিনা এবং তার দলের ওপর যে আস্থা রেখে নির্বাচনে তাদের সুচিন্তিত রায় দিয়েছে। তার সঠিক মর্যাদা দেবেন তিনি। বিগত সময়ে প্রমাণ হয়েছে, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা নিরন্তর জেগে থাকেন বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি, উন্নতসমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি সম্মানের সঙ্গে বিশ্ব দরবারে মথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় তাকে এবং অভিনন্দন তার নতুন সরকারের পথচলাকে।

লেখক : সাংবাদিক এবং সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close