রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৮ জানুয়ারি, ২০২৪

আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শাসনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল

ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধে আন্তর্জাতিক যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, সেটা বিশ্ব রাজনীতির গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রবণতার প্রতিফলন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আইনের শাসনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল। চীনের প্রভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করছেন, বহুমেরুকেন্দ্রিক একটি বিশ্বের জন্ম হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ দুটিই গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের কড়া সমালোচক। ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক এই ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে মন্তব্য করেছেন। ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও একই মন্তব্য করেন। ইসরায়েল থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে বিরোধ এখন প্রকাশ্যে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই বিভক্তির খবর এত দিন পর্যন্ত এক রকম পর্দার আড়ালেই ছিল। মাঝেমধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে গাজায় বেসামরিক জনগণের বিপুল প্রাণহানির কারণে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ দুই মিত্রের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। যারা ডেমোক্র্যাটদের অর্থ দিয়ে থাকেন, তাদের একটি সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে বাইডেন ইসরায়েলের কট্টরপন্থি সরকারের সমালোচনা করেন এবং বলেন, নেতানিয়াহুকে তার আচরণ পরিবর্তন করতে হবে।

অন্যথায় ইসরায়েলের এ সরকারের সঙ্গে এগোনো ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে একজন বিপ্লবী বলা যাবে না। তবে ৭৩ বছর বয়সি এই সাবেক পর্তুগিজ প্রধানমন্ত্রী যেন বিপ্লবী চে গুয়েভারার মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা উল্টে দেওয়ার সেই স্বপ্ন পূরণের মিশনে নেমেছেন। গত সপ্তাহে দোহা ফোরামে দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণে গুতেরেস অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম ধরে কিছু বলেননি। কিন্তু তিনি নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেওয়ার সিদ্ধান্তের যে কড়া সমালোচনা করেছেন তাতে বাইডেনের নাম উল্লেখ করার কোনো দরকার ছিল না। দোহার ওই অনুষ্ঠানে গুতেরেস বলেন, আমি নিরাপত্তা পরিষদকে মানবিক বিপর্যয় এড়াতে চাপ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম এবং একটি মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য আমার আবেদন পুনর্ব্যক্ত করেছিলাম। গুতেরেস সেখানে যা বলেছেন, তার মানে দাঁড়ায়, যদি গাজায় কোনো গণহত্যা ঘটে থাকে, তাহলে তার জন্য জো বাইডেন দায়ী। অবশ্য ইতিমধ্যেই কেউ কেউ মার্কিন প্রেসিডেন্টকে গণহত্যাকারী জো বলা শুরু করে দিয়েছেন। গাজায় ইতিমধ্যেই প্রায় ১৮ হাজার চার শ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছে। এই সংখ্যা ২৮ বছর আগে স্রেব্রেনিকায় গণহত্যায় নিহত মানুষের সংখ্যার দ্বিগুণ। তাই এটি মোটেও হেলাফেলার বিষয় নয়। গাজার সংঘাতবিষয়ক আটশতাধিক বিশেষজ্ঞ গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গণহত্যা চালাতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। ওই বিশেষজ্ঞরা ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার তীব্রতা ও ভয়াবহতা নিয়ে জোরালো প্রমাণ পেশ করেছিলেন এবং তারা ইসরায়েলি নেতাদের গণহত্যা সংঘটনের উসকানি দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তারা যত ভয়াবহ পরিস্থিতির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে এখন অনেক ভয়ানক।

যদি একটি আন্তর্জাতিক আদালত এ ঘটনার নিরপেক্ষ বিচার করে এবং তার অস্থায়ী রায় নিশ্চিত করে, তাহলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিশ্চিতভাবেই গণহত্যায় মদদ দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত হবেন। সেই রায় বাইডেনকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়েও ভয়ানক অপরাধে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করবে। এতে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই, চলতি সপ্তাহেই বাইডেনের তেজ পড়ে গেছে। তিনি দেরি করে হলেও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গাজা যুদ্ধের কারণে জনসমর্থন হারানোর বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং বিলম্বে হলেও ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বোমাবর্ষণকে নির্বিচার বলে উল্লেখ করেছেন। নির্বিচার বোমা হামলা সরাসরি একটি যুদ্ধাপরাধ। আর এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পূর্ণাঙ্গ মার্কিন সমর্থনে এবং মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেই গাজায় নির্বিচার বোমা হামলা হয়েছে। দোহা ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণার রেশ এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সাধারণভাবে অনুগত দেশ জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন, তিনি জাতিসংঘে মার্কিন ভেটোর কারণে অত্যন্ত হতাশ। সাফাদি বলেছেন, ইসরায়েল মনে করছে, তারা খুন-খারাবি করে সহজেই পার পেতে পারে। একটি দেশ সারা পৃথিবীকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাচ্ছে আর সারা পৃথিবী সেই একটি দেশকে থামাতে একেবারেই অক্ষম হয়ে আছে। তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে সেই দেশ যে কি না ইসরায়েলকে তার যাবতীয় কুকর্মের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে যাচ্ছে।

দোহার বেশির ভাগ মানুষ একমত, শান্তি আলোচনা পরিচালনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে আমেরিকানদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যদিও আন্তর্জাতিক শান্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্থলাভিষিক্ত কে হতে পারে সে বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তবে এ বিষয়ে চীন তার হাত খুলতে শুরু করেছে। একটি প্যানেল আলোচনায় চীনের স্টেট কাউন্সিলের প্রাক্তন কাউন্সেলর ড. হুইয়াও ওয়াং গাজা ইস্যুতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। দোহা ফোরামে বহু পক্ষের একটি গুঞ্জন শোনা গেছে, যার অন্তর্নিহিত মানে দাঁড়ায়, মার্কিন আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের সমাপ্তিসূচক এই ‘মাল্টি পোলার’ শব্দবন্ধটি রাশিয়া এবং ইরান উভয়ের কাছে সুমিষ্ট সংগীতের মতো মনে হতে পারে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসাইন আমিন আবদুল্লাহিয়ান অনলাইনে ওই ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। গাজা পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা দোহা বিতর্কের প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল। সেখানে জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস তার আলোচনায় বলেছেন, গাজার ভয়ংকর ঘটনায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের এই ব্যর্থতা প্রমাণ করেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবর্তিত কথিত উদার বিশ্বব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা কাঠামোর জরুরি সংস্কারের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই কাঠামো খুবই দুর্বল এবং পুরোনো। এর মাধ্যমে ৮০ বছর আগেকার একটি অকার্যকর ব্যবস্থা চালু আছে বলে প্রমাণিত হচ্ছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব হতাশার সুরে বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদ ভূকৌশলগত বিভাজনে একেবারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ইতিহাসের এক বিস্ময়কর মোচড়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন নেতানিয়াহুকে যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতাদানের মাধ্যমে তাদের নিজেদের চালু করা কথিত উদার বিশ্বব্যবস্থাকেই অসম্মান করেছে।

গাজা যুদ্ধ আরো যেসব গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবে, তার মধ্যে সিরিয়ার হায়াত তাহিরির আল-শাম ইন ইদলিব, কুর্দিনিয়ন্ত্রিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের মতো সংগঠন রয়েছে। আমরা এ ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থানের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর শক্তিক্ষয় হতে দেখব। অরাষ্ট্রীয় ও আধা রাষ্ট্রীয় এসব সংগঠনের উত্থান হলে আরব জাতিরাষ্ট্র ধারণা দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এর ফলাফল হবে মারাত্মক। এতে জাতিগত, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতাভিত্তিক নানা গোষ্ঠীর পুনর্জন্ম হবে। মধ্যপ্রাচ্যের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর বিভাজন ও ভাঙন ডেকে আনবে। আন্তসীমান্ত সম্পর্কে পরিবর্তন আসবে, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়বে। আঞ্চলিক যুদ্ধের ধরনও পরিবর্তন হতে আমরা দেখব। শহর অঞ্চলে যুদ্ধ বাড়বে। এ ছাড়া প্রক্সি যুদ্ধ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, প্রোপাগান্ডা ও অপতথ্যের বিস্তার হতে দেখব। একই সঙ্গে গাজাযুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশল-নীতিগত গুরুত্বের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় নিয়ে আসবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে চীন-রাশিয়া তাদের প্রভাব তৈরি করছিল, যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল। গাজা যুদ্ধ সেই নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনতে পারে। সম্প্রতি জেরুজালেম পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, আমরা শুরু থেকেই আরবদের জয় ঠেকাতে বদ্ধপরিকর ছিলাম। কিসিঞ্জারের মতোই বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বর্তমানে চলমান যুদ্ধের প্রথম দিনেই বলেছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা যা কিছু দরকার, তার সবই করব। ১৯৪৮ সালে যেভাবে জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনবিরোধী মিছিল, সমাবেশ ও প্রচার শুরু হয়েছিল, এবারও ইসরায়েলি দখলদার বসতি স্থাপনকারীদের সমর্থনে তা শুরু হয়েছে।

ওদিকে জার্মানরা ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠত্ববাদী ইহুদি নেতাদের উদ্দেশে স্লোগান দিচ্ছেন, বার্লিন তোমাদের সঙ্গে আছে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যেও সেই স্লোগানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যে একজোট হয়েছে, সেটি মোটেও কাকতালীয় বিষয় নয়। নামিবিয়া, তাঙ্গানিকা, রোডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, কেনিয়াসহ যত জায়গায় শ্বেতাঙ্গরা উপনিবেশ গড়েছিল, সবখানে তারা একজোট হয়েছিল। এর কারণ হলো তারা প্রচণ্ড রকম বর্ণবাদী। ইসরায়েল যেহেতু একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র, সেহেতু তারা তাদের পাশে থাকবেই। সুতরাং বলাই যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শাসনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থায় ফাটল ধরেছে, যা বিশ্ব অস্থিরতার জন্য দায়ী। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বের পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেয়, তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close