এস এম মুকুল

  ২৩ মার্চ, ২০২৩

শ্রদ্ধাঞ্জলি

একজন স্কাউট শিক্ষকের গল্প

শৃঙ্খলা, ন্যায় ও কর্তব্যপরায়ণতা, সচেতনতা সর্বোপরি দেশপ্রেমে উজ্জীবিতকরণের অনবদ্য প্রয়াসের নাম স্কাউট। স্কাউটিংমূলক একটি কার্যক্রম, যার মাধ্যমে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। তাদের মননে দেশপ্রেম এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে দায়িত্ববোধের চেতনার বীজটি বুনে দেওয়া হয়। জীবনে উন্নতি ও সফলতার জন্য যে শৃঙ্খলাবোধ প্রয়োজন স্কাউটিং মূলত সে শিক্ষাটিই দিয়ে থাকে। বর্তমান অসহিষ্ণু-অস্থির সময়ের সমাজব্যবস্থায় স্কাউটিং হতে পারে সুনাগরিক গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্কাউটিংয়ের পরিসর বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে শিশু-কিশোর স্কাউটারদের মননে সামাজিক গুণাবলি উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের পরিবার, সমাজ, দেশ তথা বিশ্বের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কর্তব্য, নিজের প্রতি কর্তব্য এবং অপরের প্রতি কর্তব্য পরিপালনে স্কাউটের ৩টি মূলনীতি রয়েছে সুনাগরিক গঠনে।

স্কাউটিং মূলত একটি আন্তর্জাতিক, শিক্ষামূলক ও অরাজনৈতিক আন্দোলন- যার মাধ্যমে শিশু, কিশোর ও যুবকদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আধ্যাত্মিকভাবে যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়। বিশুদ্ধ মনন বিকাশে স্কাউটিং হলো একটি অনিন্দ প্রক্রিয়া। স্কাউটিং বিশ্বের একমাত্র সংগঠন, যেখানে যোগদান করতে হলে আত্মশুদ্ধি পালন করতে হয়। আগ্রহীদের অতীত জীবনের সব বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করার শপথ নিতে হয়। মদ, জুয়া, যৌনতা, শঠতা ও নাস্তিকতা নামের পাঁচটি শিলাখণ্ড থেকে জীবনতরীকে রক্ষা করতে হয়। স্কাউট-প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হয়। স্কাউট-প্রতিজ্ঞাটি হলো- ‘আমি আমার আত্মমর্যাদার ওপর নির্ভর করে প্রতিজ্ঞা করছি যে, আল্লাহ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে, সর্বদা অপরকে সাহায্য করতে ও স্কাউট আইন মেনে চলতে আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’ এই শিক্ষা বর্তমান অস্থির সমাজব্যবস্থায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্কাউট দিবস। স্কাউটিংয়ের ইতিহাস থেকে জানা যায়, স্কাউটিং আন্দোলনের প্রবক্তা লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তারই হাত ধরে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে স্কাউটিং আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এই কারণে ২২ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিশ্বব্যাপী স্কাউট দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৩৮ মিলিয়ন স্কাউটার এই দিবসটি পালন করে। বর্তমানে বিশ্বের ২১৭টি দেশে তিন কোটি ৮০ লাখ স্কাউট ও গাইড রয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে স্কাউটিংয়ের যাত্রা শুরু ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪৭-এর পর ইস্ট পাকিস্তান বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশনের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ বয়স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্ব স্কাউট সংস্থা ১৯৭৪ সালের ১ জুন বাংলাদেশ স্কাউট সমিতিকে ১০৫তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে ১৮ জুন পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল সভায় আবার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ স্কাউটস। ১৯৯৪ সালে ২৪ মার্চ একাদশ সভায় বিশ্ব স্কাউট সংস্থার অনুমোদনক্রমে গার্ল-ইন-স্কাউটিং চালু করে বাংলাদেশে। তখন থেকে মেয়েরা এর সদস্য হওয়ার অধিকার লাভ করে। বাংলাদেশ স্কাউটের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ স্কাউটস কার্যক্রম শুরু করেছিল মাত্র ৫৬,৩২৫ জন সদস্য নিয়ে। ১৯৭৮ সালে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। তখন এই কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে সবস্তরের জন্য ট্রেনিং কোর্সসমূহ পরিচালনার মাধ্যমে ১৯৮৫ সালের মধ্যে স্কাউটারের সংখ্যা ৫ লাখে উন্নীত হয়। এরপর বাংলাদেশ স্কাউটস ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে গ্রহণ করে স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান-২০১৩। এ প্ল্যানে স্কাউটদের শুধু সংখ্যাবৃদ্ধিই নয়, গুণগত মান অর্জনেরও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। ২০১৭ সালের মধ্যে স্কাউটের সংখ্যা ১৬,৮২,৭৬১-এ পৌঁছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব স্কাউট সংস্থায় ৫ম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কমিউনিটি সেবা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিশুকল্যাণ, নির্মাণ ও সস্তায় বাড়িঘর তৈরিতে স্কাউটরা সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়া বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিতে, অসহায় মানুষের আশ্রয় বা পুনর্বাসনে তারা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করে। একজন স্কাউটারের মানবীয় বিকাশে স্কাউটের ৭টি আইন- স্কাউট আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী, স্কাউট সবার বন্ধু, স্কাউট বিনয়ী ও অনুগত, স্কাউট জীবের প্রতি সদয়, স্কাউট সদা প্রফুল্ল, স্কাউট মিতব্যয়ী, স্কাউট চিন্তা, কথা ও কাজে নির্মল। আমি মনে করি শিশু-কিশোর-যুবদের সুস্থ মানসিক বিকাশে এবং সুনাগরিক গঠনে স্কাউটিং একটি অবিকল্প কার্যক্রম।

বাংলাদেশ স্কাউটস সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য আমরা জেনে নিতে পারি। স্কাউটদের সংখ্যারভিত্তিতে বিশ্ব স্কাউটে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশ স্কাউট অগ্রাধিকার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯টি উচ্চপর্যায়ে জাতীয় কমিটি গঠন করছে। যেগুলোর সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন বিশিষ্ট ও অভিজ্ঞ স্কাউটরা। বাংলাদেশ স্কাউটসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ হচ্ছে জাতীয় স্কাউট কাউন্সিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও চিফ স্কাউট এ কাউন্সিলের প্রধান। স্কাউট জাতীয় কাউন্সিলের সভা প্রতি বছর সদর দপ্তরের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়। দেশব্যাপী স্কাউট আন্দোলনের সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে পেশাগতভাবে প্রশিক্ষিত প্রায় ৫০ জন স্কাউট এক্সিকিউটিভ রয়েছেন। বাংলাদেশ স্কাউটের যাবতীয় কার্যক্রম জাতীয় সদর দপ্তর, স্কাউট ভবন থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ স্কাউট আন্দোলন প্রধানত তিনটি শাখায় বিভক্ত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৬ থেকে ১০+বয়সি শিশুদের কাব স্কাউট, স্কুল ও মাদরাসায় ১১ থেকে ১৬+বয়সি বালক-বালিকাদের স্কাউট এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭-২৫ বয়সি যুবককে রোভার স্কাউট বলে। তবে রেলওয়ে, নৌ এবং এয়ার অঞ্চলের চাকরিজীবীদের জন্য ৩০ বছর পর্যন্ত বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে মুক্ত দল। উৎসাহী বয়স্করা স্কাউটের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে ইউনিট লিডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকম-লী বাংলাদেশ স্কাউটের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট রয়েছেন।

আমি স্কাউটার নই। তবে আমি একজন স্কাউট শিক্ষকের গর্বিত সন্তান। আমার আব্বা মরহুম আবদুল আজিজ শাহ্ (১৯৯০) নেত্রকোনো জেলায় স্কাউটিং এবং ক্রীড়া বিকাশে পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন। আমার আব্বা নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের স্কাউট ও ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্কাউটিং বিকাশে সেই সময়ের একজন স্কাউট শিক্ষকের গল্প শোনাব আজ। ৫-৭ বছর আগের কথা। পাহাড় দেখতে গেছি পাহাড়ের পাদদেশে। সুনামগঞ্জের ভোলাগঞ্জ উপজেলায়। এই প্রথম সেখানে যাওয়া। পাহাড়ের একেবারেই সন্নিকটে ছোট্ট একটা বাজার। ঘুরে ঘুরে বাজার দেখছি। পাহাড়ের খুবই কাছে। অপরূপ জায়গা। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে চায়ের দোকানে ঢুকলাম। লক্ষ করলাম পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন লোক আমাকে পরখ করে দেখছেন। আমি গুরুত্ব দিলাম না। লক্ষ করলাম, তার চোখে-মুখে জিজ্ঞাসার ছাপ স্পষ্ট। ইতস্তত করে তিনি সরাসরি বলেই বসলেন, আপনি কি শাহ্ আজিজ স্যারের ছেলে? আমি হতভম্ব চিত্তে ভালো করে লোকটিকে দেখলাম। দুর্গম এই পাহাড়ের পাদদেশে এভাবে কী করে আমাকে চিনলেন তিনি। ইতস্তত না করে- সহাস্য জবাব দিলাম, জি আমি শাহ্ আজিজ স্যারের ছেলে। তারপর অনেক গল্পে চলে গেলেন। সত্তর দশকের গল্প। তিনি বলতে লাগলেন- তোমাকে তুমি করেই বলি। তোমার আব্বা আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক। আমাদের শাহ্ আজিজ স্যার। সত্তর দশকের কঠিন সময়ে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কাউটের ছাত্র জোগাড় করতেন। জোগার শব্দটা কেন বললাম জানো, তখন আমাদের মতো কৃষিনির্ভর পরিবারে প্রাইমারি পাসের পর হাইস্কুলে যাওয়ার সুযোগ খুব কম ছাত্রেরই হতো। তার পরও যাদের হতো তাদের অনেকেই সেভেন, এইটে গিয়ে ঝরে পড়ত। কারণ আমাদের গরিব কৃষক বাবাদের পক্ষে পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। এমন একটা সামাজিক অবস্থার মধ্যে স্কাউটিংয়ে ছাত্রদের নিয়ে যাওয়াটা ছিল অনেকটা বিলাসিতার মতোই। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল তোমার আব্বা শাহ্ আজিজ স্যারের ঐকান্তিক আগ্রহের ফলে। তিনি স্কাউটিংয়ে ছাত্রদের আগে মানসিকভাবে তৈরি করতেন। তারপর ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে রাজি করাতেন। কারো কারো ক্ষেত্রে স্কাউটারের পোশাক তিনি সাবেকদের থেকে চেয়ে এনে দিতেন। সেই পোশাক মাপমতো বানানোর জন্য দর্জি ঠিক করে দিতেন। অত সহজ ছিল না ব্যাপারটা। স্যার দায়িত্ব নিয়ে কাজগুলো করেছেন। অবাক হয়ে শুনলাম আমার শিক্ষক বাবার স্কাউটিং বিকাশের এই গল্প।

আব্বার এমন ভূমিকার গল্প আমাকে গর্বিত করে। আমি নিজেও অনেক ঘটনা দেখেছি উনার একজন ছাত্র এবং সন্তান হিসেবে। ভাটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ভরসাস্থল ছিলেন শাহ্ আজিজ স্যার। তাদের বেতন মওকুফ লাগবে শাহ্ আজিজ স্যার। কারো বই কেনার পয়সা নাই, পুরোনো বই সংগ্রহে সহায়তা লাগবে শাহ্ আজিজ স্যার। বিশেষত স্কাউটের জন্য আব্বাকে নিজেকে উজাড় করে দিতে দেখেছি। এমন একজন স্কাউট শিক্ষকের সন্তান হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখি অবিরাম। জয়তু বাংলাদেশ স্কাউট। সব স্কাউটারের স্কাউট স্যালুট।

লেখক : বিশ্লেষক, কলাম লেখক এবং সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close