মেহেদী হাসান বিপ্লব

  ২৩ নভেম্বর, ২০২২

মুক্তমত

জাতীয় পতাকার অসম্মান কখনোই কাম্য নয়

একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হলো পতাকা। বিশ্বে কোনো জাতির স্বাধীনতা বা স্বতন্ত্রতা পতাকার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। ঠিক তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেরও জাতীয় পতাকা আছে। পতাকাটি হলো সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। আর সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক এবং বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য ও স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারিভাবে গৃহীত হয়।

কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সদস্য ১৯৩টি দেশ। আরো দুটি দেশ রয়েছে পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে। এসব সদস্য দেশের অনেক দেশ বরাবরই স্বাধীন দেশ হিসেবে থেকেছে। আবার অনেক দেশ পরাধীনতা বা উপনিবেশ থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কোনো কোনো দেশ আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনো কোনো দেশ বিপক্ষ শক্তিকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের মতো খুব কম দেশই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা চালানো হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঢাকাসহ সারা দেশে গণহত্যা চালানোর পর বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বহু বেসামরিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। মুত্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের পুরোটা সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ও তাদের এ দেশীয় ঘাতক চক্রের হাতে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী আধাসামরিক বাহিনী ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে এবং ২ লাখ থেকে ৪ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি ঘটে। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশকে ঘাতকরা হত্যা করে। পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের ঠিক দুই দিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা থেকে অন্তত শতাধিক চিকিৎসক, অধ্যাপক, লেখক ও প্রকৌশলীকে তুলে নিয়ে হত্যা করে এবং তাদের মরদেহ বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে।

সুতরাং বাঙালি জাতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক লাল-সবুজের পতাকা এমনি এমনি পায়নি। বরং এটি অর্জন করতে বাঙালি জাতিকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে। অনেক অত্যাচার- নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে ইত্যাদি।

অথচ চার বছরের বিরতি দিয়ে যখন আবারও পুরো বিশ্ব মেতে উঠছে ফুটবল বিশ্বকাপের উত্তেজনায়। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ নামে পরিচিত ফুটবল বিশ্বকাপ এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। ঠিক তখনই ফুটবল বিশ্বকাপের এই উন্মাদনা প্রতিবারের মতো আবারও বাংলাদেশে শুরু হয়ে গেছে। দেশের তরুণ-তরুণী, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত উত্তেজনাকর পরিবেশ তৈরি করছে। তারা ফুটবল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দলের সমর্থক হয়ে নিজের মধ্যে বাড়াবাড়ি, ঝগড়াঝাটি কিংবা মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে। এমনকি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় যেমন- ঘরবাড়ি, দোকান, বাজার, রাস্তার মোড়, কলেজ-ইউনিভার্সিটি ইত্যাদিতে ফুটবল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়ানো হচ্ছে। ফুটবলপ্রেমীদের দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করার দৃশ্য তেমন চোখে না পড়লেও ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি ইত্যাদি দেশের পতাকার প্রতি তাদের সম্মান ও ভালোবাসা অত্যন্ত গভীর, যা চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবস অথবা অন্য কোনো সময় দেশের তরুণ-তরুণীদের কিংবা বিভিন্ন শ্রেণি, বয়সের মানুষদের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনস্বরূপ ঘরবাড়ি, দোকান, বাজার, রাস্তার মোড় ইত্যাদিতে জাতীয় পতাকা উড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন প্রতিযোগিতা করতে দেখা যায় না। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপের বেলায় তা অহরহ চোখে পড়ার মতো। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, পাড়ামহল্লায় গেলে ভিন্ন দেশের পতাকায় বাংলাদেশকে হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা তৈরি হয়। তারা বাংলাদেশে বসবাস করে ভিন্ন দেশের পতাকা হাতে নিয়ে সেই দেশকে সমর্থন করে। এটা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার জন্য অপমানকর ও অসম্মানজনক। আর বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের জন্যও অপমানকর ও অসম্মানজনক। আমাদের সমাজের কিছু মানুষ আবার বলার চেষ্টা করেন যে, এটা খেলার বিষয়। তাই সিরিয়াসভাবে নেওয়া অনুচিত। তাদের উদ্দেশে একটা কথা রেখে যেতে চাই, বাংলাদেশের পতাকা আমরা সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করেছি। এই লাল-সবুজের পতাকা অর্জনের পেছনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেককে শহীদ হতে হয়েছে। হাজারো অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে ইত্যাদি।

এজন্য বাংলাদেশের মাটিতে একমাত্র আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক আমাদের জাতীয় পতাকা উড়বে। জাতীয় পতাকা যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পাবে- এটাই কাম্য। এখানে ভিন্ন দেশের পতাকা উড়তে পারে না। কোনোভাবেই ভিন্ন দেশের পতাকা বাঙালি জাতির কাছে বড় হতে পারে না। যদি হয় তবে তা লজ্জাস্কর ও অপমানকর হবে। তাই আসুন খেলা খেলার জায়গায় রাখি, এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি। দেশকে ভালোবাসি, দেশের জাতীয় পতাকাকে সম্মান করি। ভিন্ন দেশের পতাকা উড়ানো থেকে বিরত থাকি, জাতীয় পতাকা উড়ানোর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রতা ও ঐক্যতার কথা জানান দিয়ে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ি।

লেখক : শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close