ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন

  ১০ আগস্ট, ২০২০

পর্যালোচনা

অ্যাজমা রোগীরা সতর্ক থাকুন

হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। করোনাকালে যাদের হাঁপানির সমস্যা রয়েছে তারা বেশি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন। তাই এ সময় অবশ্যই হাঁপানি রোগীদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। হাঁপানি হচ্ছে একটি ক্রনিক সমস্যা, যা শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা তৈরি করে। এটি এমন একটি সমস্যা, যা প্রাণঘাতীও হয়। এক একজনের ক্ষেত্রে হাঁপানির সমস্যা এক এক রকমের হতে পারে। হাঁচি, কাশি, বুকে চাপা ভাব, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ইত্যাদি হাঁপানির অন্যতম লক্ষণ। হাঁপানি, ক্রনিক ব্রংকাইটিস, আইএলডি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন যারা, তাদের শ্বাসতন্ত্র নাজুক থাকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে তাই তাদের জটিলতার আশঙ্কা বেশি। এ ধরনের রোগীর তীব্র নিউমোনিয়াই শুধু নয়, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিন্ড্রোমও (এআরডিএস) হতে পারে। এআরডিএসে ফুসফুসের টিস্যু পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না।

কিছু কিছু খাবার আছে যা হাঁপানি রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দেয়। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে গতকাল শনিবার ৮ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্বে ১,৯২,৬৬,৪০৬ জনের মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৭,১৮,৫৩০ জন। বাংলাদেশেও আক্রান্তের সংখ্যা ২,৫২,৫০২ জনের মতো। মৃত্যু হয়েছে ৩,৩৩৩ জনের। অজানা এই ভাইরাসটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। হাঁপানি দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রীয় রোগে ভুগছেনÑ এমন ব্যক্তিদের করোনাভাইরাসে সংক্রমণজনিত জটিলতার ঝুঁকি অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশের শ্বাসতন্ত্রীয় সমস্যা ছিল। যেসব ফুসফুসীয় রোগ করোনা জটিলতার উচ্চঝুঁকি বহন করে, তা হলো অ্যাজমা ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)। সিওপিডির মধ্যে ক্রনিক ব্রংকাইটিস ও এল্ফিম্ফসেমা উভয়ই রয়েছে। সিওপিডির প্রধান কারণ হচ্ছে ধূমপান। তাই যারা বছরের পর বছর ধরে ধূমপান করে আসছেন, তাদের করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সৃষ্ট জটিলতার বাড়তি ঝুঁকি রয়েছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই রোগটি সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে পর্যাপ্ত গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ও অ্যালোপ্যাথিতে হাঁপানির কোনো স্থায়ী চিকিৎসা আজও আবিষ্কৃত হয়নি, রোগটিকে শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়, কিন্তু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মাধ্যমে সেটিকে পূর্ণ আরোগ্য করা যায়। আমাদের দেশের হাঁপানির সঠিক কোনো পরিসংখ্যান জানা না থাকলেও আমেরিকায় প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ অ্যাজমায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ১০ মিলিয়নই (এরমধ্যে তিন মিলিয়ন শিশুও আছে) ভুগছেন অ্যালার্জিজনিত অ্যাজমায়। তাই বলা যায়, আমাদের দেশেও অ্যাজমার প্রকোপ কম নয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক ও নিয়মিত চিকিৎসা ও পরিকল্পিত জীবনযাপনের মাধ্যমে এ রোগীরা অ্যাজমার তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আবার পৃথিবীর মধ্যে বেশ কিছু দ্বীপে এই রোগের প্রকোপ খুব বেশি। যেমন ত্রিস্তা-দে-কুনে দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে শতকরা ৪৬ ভাগেরও বেশি মানুষ এই রোগের শিকার ছিল, আর একটি দ্বীপ যার নাম করিলিস্কি সেখানেও প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ মানুষ এই রোগে ভুগে থাকেন। অনুরূপে পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে, যেখানে এই রোগীর হার খুবই কম যেমন জাম্বিয়া, নাইজেরিয়া, কেনিয়া।

হাঁপানি এমন একটি দুরারোগ্য ব্যাধি যাতে একবার আক্রান্ত হলে দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে রোগীকে সারা জীবন কাটাতে হয়। হাঁপানি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কখনো সামাজিক বা পারিবারিক আনন্দ উল্লাসে যোগদান করতে পারেন না, পারেন না কোনো পরিশ্রমের কাজে অংশ নিতে। তাকে অনেক সময় গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে হয়। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই ঠান্ডা আবহাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। বর্ষার ঠান্ডায়, শীতের ঠান্ডায় রোগ বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ব্রংকিয়াল হাঁপানি শীতকালে বাড়ে। শীতের ঠান্ডা রোগীর অসহ্য। শীতকালে নাকে একটুখানি ঠান্ডা বাতাস বা কুয়াশা প্রবেশ করলেই প্রথমে হাঁচি, নাক ঝরা ও পরে শ্বাসকষ্ট দেওয়া দেয়। বর্ষাকালে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি গায়ে পড়লে, খোলা জানালার পাশে রাতে ঘুমালে, ভেজা বাতাসে ভ্রমণ করলে রোগ লক্ষণ বৃদ্ধি পায়।

মিশ্র অ্যাজমা। এ ক্ষেত্রে রোগী পূর্বোক্ত অ্যালার্জিক ও নন-অ্যালার্জিক দুই ধরনের অ্যাজমাতেই ভোগেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকোপ বেড়ে যায়। রাত্রিকালীন অ্যাজমা এ ধরনের হাঁপানি রাতের বেলা, বিশেষত রাত ২টা থেকে ৪টার মধ্যে আক্রমণ করে। রোগীর শারীরিক দুর্বলতার জন্য রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। এমনকি দিনের বেলায় স্বল্পকালীন নিদ্রা যায়। রাত্রিকালীন অ্যাজমা গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করা উচিত। কারণ এ ক্ষেত্রে রেসপিরেটরি অ্যারেস্ট হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটে।

ব্রংকিয়াল অ্যাজমা। এটি মূলত এক ধরনের অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন; যাতে শ্বাসকষ্ট ও বুকে সাঁই সাঁই শব্দ হয়। শ্বাসনালির চারপাশের পেশি ও মিউকাস মেমব্রেনসমূহের সংকোচন দেখা দেয়। শ্বাসনালির সংক্রমণ, বায়ুবাহিত অ্যালার্জেন, খাদ্যের অ্যালার্জেন ও অত্যধিক মানসিক চাপ এর প্রধান কারণ। কার্ডিয়াক অ্যাজমা-হৃৎপিন্ড যখন তার স্বাভাবিক রক্ত সংবহন হারিয়ে ফেলে তখন পালমোনারি ইডিমা বা ফুসফুসে পানি জমে বায়ুনালিকে সংকুচিত করে ফেলে এবং হাঁপানি সৃষ্টি হয়। এটি অত্যন্ত মারাত্মক। ঘুমানোর কয়েক ঘণ্টা পর এটি আক্রমণ করে। কারণ শুয়ে থাকলেই ফুসফুসে পানি জমে। শ্বাসকষ্টে রোগীর ঘুম ভেঙে যায় এবং কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। ব্যায়ামজনিত অ্যাজমা এ ধরনের অ্যাজমা ব্যায়ামকালীন অথবা ব্যায়ামের কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হয়। বিশেষত শীতকালে এ ধরনের সমস্যা বেশি হয়। পেশাগত অ্যাজমা-অকুপেশনাল বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাজমা সাধারণত চাকরি নেওয়ার কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যে দেখা দেয়। সাধারণত কর্মস্থল ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে বা ছুটিতে থাকাকালীন লক্ষণসমূহ কমে যায়। ‘স মিলের গুঁড়া, রাসায়নিক ধোঁয়া, সর্বদা ধুলাবালিযুক্ত পরিবেশ, সিমেন্ট কারখানা, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, আটা ও মসলার মিল, রাইস মিল, জুট মিল, স্পিনিং মিল, রঙের কারখানা, রাসায়নিক সার-কারখানা, ফটোকপি মেশিন, ড্রাইভিং, পোলট্রি ফার্ম, বেডিং স্টোর ইত্যাদিতে কর্মরত শ্রমিকরা এ ধরনের হাঁপানিতে বেশি আক্রান্ত হন। মৌসুমি অ্যাজমা-মৌসুমি অ্যাজমা সাধারণত বিশেষ ঋতুতে দেখা দেয়। যেমনÑ কারো কারো গরমে অ্যাজমা বাড়ে, কারো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ফুলবাগানে অ্যাজমা বাড়ে। গাছ, ঘাস, ফুলের রেণু ইত্যাদিতেও অ্যাজমা বাড়ে। নীরব অ্যাজমাÑ এ ধরনের হাঁপানির আক্রমণ অত্যন্ত ভয়াবহ ও জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। কোনোরূপ পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই বা বুকে হালকা শব্দ করেই আক্রমণ করে।

অ্যাজমা রোগীকে কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে। ১. বিছানা ও বালিশ প্লাস্টিকের সিট দিয়ে ঢেকে নিতে হবে বা বালিশে বিশেষ ধরনের কভার লাগিয়ে নিতে হবে। ২. ধুলো ঝাড়াঝাড়ি করা চলবে না। ৩. ধোঁয়াযুক্ত বা খুব কড়া গন্ধওয়ালা পরিবেশে থাকা চলবে না। ৪. আলো-হাওয়া যুক্ত, দূষণমুক্ত খোলামেলা পরিবেশ থাকা দরকার। কারণ স্যাঁতসেঁতে জায়গায় ফাঙ্গাল স্পোর অনেক সময় হাঁপানির কারণ হয়। ৫. হাঁপানি রোগীর আশপাশে ধূমপান বর্জনীয় ও মশার কয়েল জ্বালানো যাবে না। ৬. অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্যও হাঁপানি রোগীরা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই নিজের শরীরের অবস্থা বুঝে পরিশ্রমের ঝুঁকি নেওয়া উচিত। ৭. হালকা খাওয়া-দাওয়া করা উচিত, যাতে হজমের কোনো অসুবিধা না হয়। কারণ, বদহজম এবং অম্বল থেকেও হাঁপানি হতে পারে। যে খাবারে অ্যালার্জি আছে তা বর্জন করে চলতে হবে। ৮. প্রয়োজনে স্থান ও পেশা পরিবর্তন করতে হবে। শুধু নিয়ম মেনে চললেই এই ধরনের রোগীর শতকরা ৫০ ভাগ ভালো থাকার সুযোগ রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে চিরন্তন সত্য বলে কিছুই নেই । কেননা একসময় শুনতাম যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই, বর্তমানে যক্ষ্মা ভালো হয়। সবকিছু বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ফসল। সুতরাং বিজ্ঞানের পরামর্শ মেনে চললেই শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখা সম্ভব।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close