ডা. এ এস এম বদরুদ্দোজা

  ৩১ জুলাই, ২০২০

বিশ্লেষণ

একটি ক্ষুদ্র দানব কোভিড-১৯

আদিকাল থেকে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে যে ক্ষুদ্র দানব, তার নাম ‘ভাইরাস’। লাতিন শব্দ ‘ভাইরাসের অর্থ ‘বিষ’। পৃথিবী বিভিন্ন সময়ে করোনার মতো মহামারির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে কোটি কোটি মানুষের। বদলে দিয়েছে জীবনাচারণ, পরিবর্তন এসেছে বিশ্বব্যবস্থায়। তবে থেমে থাকেনি নতুন আবিষ্কারও; এতে সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থা। কিন্তু অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের আছে ভয়ংকর মারণ ক্ষমতা। এসব ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে নভেল করোনাভাইরাস, ইবোলাভাইরাস, রেবিজ ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, গুটি বসন্ত, ডেঙ্গু, এইচআইভি ভাইরাস, সার্স, পোলিও, মারবুর্গ, জিকা ভাইরাস, ম্যালেরিয়া, নিপাহ ভাইরাস ইত্যাদি।

প্রাণঘাতি এসব ভাইরাসের মধ্যে মাত্র কয়েকটির ভ্যাকসিন ও ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তার পরও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। প্রতি বছর এসব ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। রেবিজ ভাইরাসের সংক্রমণে হয় জলাতঙ্ক। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বছরে বিশ্বে জলাতঙ্কে প্রাণ হারায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। কার্যকর ভ্যাকসিন থাকা সত্ত্বেও আক্রান্ত ব্যক্তিকে সময়মতো ভ্যাকসিন না দেওয়ার কারণে জলাতঙ্কের আতঙ্ক থেকে মুক্ত হওয়া যাচ্ছে না।

বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাস এক ভয়ংকর আতঙ্কের নাম। এই ভাইরাস কোথা থেকে এসেছে, কীভাবে ছড়ায়, কতটা ভয়ংকর, এর চিকিৎসা কী ইত্যাদি এখন আমাদের দেশের ১০ বছরের একটি শিশুও জানে। কারণ, ঘরে বন্দি শিশুদের এখন সময় কাটে টেলিভিশনে এসব সংবাদ শোনে এবং বাবা-মায়ের আলোচনার মাধ্যমে। আমি তাই সে বিষয়ের দিকে যেতে চাইছি না। কিন্তু এই ভাইরাসটি গঠন পরিবর্তন করে নিত্যনতুন রূপ নিচ্ছে এবং মানুষের দেহে ইতোমধ্যেই ‘মিউটেনস’ তৈরি হয়েছে। ফলে এটি আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে অনেকের মতো আমিও শঙ্কায় আছি। এ অবস্থায় ভাইরাসটি কত বিপজ্জনক, সেটা একটা প্রশ্ন। তবে আশার কথা গবেষকরা বলছেন, হাতের কাছেই হয়তো করোনার মারণ ক্ষমতা কমানোর ওষুধ রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ ফেনোফাইব্রেট। জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দাবি করেছেন, এই ওষুধে কাবু হচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রাণঘাতি ক্ষমতা। তা ছাড়া এই ওষুধ করোনার সংক্রমণকে সাধারণ ঠা-া লাগার সমস্যায় পরিণত করছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে বা কোলেস্টেরল রয়েছে, তাদের শরীরে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আর তাদেরই এই ওষুধে মৃত্যুর ঝুঁকি কমছে।

এদিকে, রেমডেসিভির ট্যাবলেটেও করোনায় মৃত্যুহার কমছে ৬২ শতাংশ। ১৪ দিনেই সুস্থ হচ্ছেন করোনা রোগী। বিশ্বে যে ৭০ ধরনের ওষুধের সলিডারিটি ট্রায়াল চলছে, তার মধ্যে প্রথম সারিতেই রয়েছে অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির। করোনায় আক্রান্ত মৃদু ও মাঝারি রোগীর চিকিৎসায় বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ‘ফ্যাভিপিরাভি’র ওষুধের সংক্ষিপ্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৯৬ ভাগ রোগীর সেরে ওঠার প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি করেছে কোম্পানিটি।

রাজধানীর ৪টি হাসপাতালে করোনা রোগীদের ওপর পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র ১০ দিনের ওষুধ সেবনেই ৯৬ ভাগ রোগী ভালো হয়ে উঠছেন। তবে করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময়ে ওষুধ পাওয়ার বিষয়টি স্বস্তির হলেও এর দাম নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বলছে, সরকার নির্ধারিত ১১৭টি ওষুধের বাইরে তারা অন্য কোনো ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কোম্পানিগুলো সে ওষুধের দাম নির্ধারণ করে। কোম্পানিগুলো প্রতিটি ‘রেমডেসিভির’ ইনজেকশনের দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করেছে।

‘রেমডেসিভির’ ইনজেকশন ব্যবহার করা হবে শুধু হাসপাতালে জটিল রোগীদের চিকিৎসায়। আর পাঁচ থেকে ১০ দিনের মেয়াদে দেওয়ার প্রয়োজন হবে। এসকেএফ, ইনসেপ্টা এবং বিকন ফার্মা বলছে, তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে হবে। অর্থাৎ যারা পাঁচ দিন এ ওষুধ ব্যবহার করবেন, তাদের খরচ হবে সাড়ে ২৭ হাজার টাকা। আর ১০ দিন করে নিলে খরচ হবে ৫৫ হাজার টাকা। তাহলে কী দাঁড়াল? ওষুধ এলেও তা সবার নাগালে থাকছে না। এখানে মানুষের জীবনের চেয়ে মুনাফায় নজর বেশি। তবে কোম্পানিগুলো বলছে, বিশ্ববাজারের পরিস্থিতি, কাঁচামালসহ অন্য ফ্যাক্টরগুলোই ওষুধটির দাম বেশি হওয়ার মূল কারণ।

এ ছাড়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের দুজন চিকিৎসক স্ক্যাবো-৬ ও ডক্সিসাইক্লিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিয়েছেন। কিন্তু ডক্সিসাইক্লিন ভাইরাস নির্মূলে কাজ করে না। আর স্ক্যাবো-৬ ব্যবহার হয় ফাংগাসের জন্য। তবে এটা করোনার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। গলাব্যথা থাকলে এটা খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু যখন এই রোগ বেশি হবে অর্থাৎ ফুসফুস সংক্রমিত হবে, তখন এটা কাজ করবে না। তবে উদ্যোগটা সফল। এভাবে চিকিৎসা নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি চলছে অচল হয়ে পড়া অর্থনীতি সচল করার কর্মকা-।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, আমরা সবকিছু একবারে বন্ধ করে রাখতে পারব না। আমাদের মহামারির সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলতে হবে। জীবনের সঙ্গে জীবিকার বিষয়টিও ভাবতে হবে। তাই এই ভাইরাস ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল করে দিয়েছেন তিনি। এতে জীবিকাও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। তিনি এই মহামারি মোকাবিলায় কঠোর পরিশ্রম ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে চলেছেন। কিন্তু তার এই পরিশ্রম ও সিদ্ধান্ত সফল হবে যদি আমরা একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি। লকডাউন এলাকায় তুরস্কে উসমানী শাসনামলের ‘ঝুলন্ত রুটি’ চালু করতে পারি। যিনি দোকানে পণ্য কিনতে আসবেন, তিনি যদি ৫০ কেজি চাল থেকে দুই কেজি একটি নির্দিষ্ট পাত্রে রেখে দেন, তাহলে যার প্রয়োজন, তিনি সেখান থেকে সেটা নিতে পারবেন। এভাবে সবাই যদি যার যার সাধ্যমতো প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে কিছু অংশ রেখে দেন, তাহলে লকডাউন এলাকায় একটা সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে। অভাবী মানুষও খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। খাবারের জন্য কাউকে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। লকডাউন কার্যকর হবে।

তাই সরকার স্বাস্থ্যবিধিতে যা বলছে, সেটা মেনে চলা উচিত। কিন্তু টিভিতে মাঝে-মধ্যে যা বলছে, তার পুরোটা কিন্তু সত্য নয়। যেমনÑ আমি সেদিন দেখলাম টিভিতে বলছেÑ কোভিড-১৯ ফল থেকে ছড়ায় না। এটা সত্য নয়, কারণ, একটা ফল তো অনেকে স্পর্শ করেন। যিনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত তিনি যেমন স্পর্শ করছেন, আবার যিনি আক্রান্ত নন, তিনিও স্পর্শ করছেন, ফল যিনি বিক্রি করছেন, তার শরীরেও তো এই ভাইরাস থাকতে পারে। সুতরাং এতে সংক্রমণ ছড়াবেই। কারণ, রোগটিই ছোঁয়াচে। তাই ফলটি খাওয়ার আগে লবণ-পানিতে ধুয়ে খেলে ভালো।

আবার কেউ কেউ বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাস কাগজ থেকে ছড়ায় না। কিন্তু আমার প্রশ্ন, কেন ছড়াবে না? কাগজটি মেশিন থেকে বের হওয়ার পর পাঠকের কাছে পৌঁছাতে কমপক্ষে ১৫-২০ জনের হাতের ছোঁয়া পায়। এতে তো সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যায়। সে যাক। কিন্তু এতসবের মধ্যে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তা হচ্ছে রাজধানীতে নিজের অজান্তে অনেকে আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এখন তারা আইইডিসিআরের হিসাবে বাড়ি ও হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের সংখ্যা অনেক। আর সংক্রমিতদের মধ্যে কেউ মারা না গেলে তিনিও সুস্থ হয়েছেন বলে ধরা হচ্ছে। তাই এখন যাদের সুস্থ ঘোষণা করা হচ্ছে, তাদের সবাই যে নেগেটিভ হবেন, বিষয়টি এমন তো নাও হতে পারে। দেখা গেছে, লক্ষণ নেই, কিন্তু শরীরে ভাইরাস রয়ে গেছে। এ কারণে দ্বিতীয় নমুনা পরীক্ষার পরই সুস্থ ঘোষণা করা উচিত।

একটা গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করার ইচ্ছা চেপে রাখতে পারলাম না। গল্পটা হলোÑ একটা হরিণী, যার বাচ্চা হবে। সে প্রসবের জন্য একটা মনোরম জায়গা বেছে নিল। কিন্তু এমন সময় একটা ক্ষুধার্ত বাঘ হরিণীকে খাওয়ার জন্য তেড়ে এলো, একটি লোকও তীর ছোড়ার অপেক্ষা করছে। আবার বনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। হরিণীটির যাওয়ার কোনো উপায় থাকল না। এ অবস্থায় সে চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে লাগল। সংকল্প করল, যে অবস্থা আসুক আমি বাচ্চা প্রসব করবই। তখন আচমকা ঝড় শুরু হলো। আগুন নিভে গেল। শিকারি হরিণীর দিকে তীর ছুড়লেও তা বাঘের গায়ে লেগে বাঘটা মরে গেল। বজ্রপাতে শিকারিও অন্ধ হয়ে গেল। হরিণী বাচ্চা প্রসব করল। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা চাইলে কাউকে যেমন বাঁচাতে পারেন; আবার মারতেও পারেন। সব কথার শেষ কথাÑ ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’!

লেখক : প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন

চেয়ারম্যান, সিটি ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close