আবু আফজাল সালেহ

  ১১ জুলাই, ২০২০

বিশ্লেষণ

কোভিডের প্রভাবে ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তা

৯ জুলাই-২০২০ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ‘অক্সফাম’ ক্ষুধা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। চলতি বছর করোনাভাইরাস মহামারিজনিত বিরূপ প্রভাবের কারণে সৃষ্ট খাদ্য সংকটে বহু লোক মারা যাবে বলে সংস্থাটি প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ না মৃত্যুবরণ করবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবে ক্ষুধার যন্ত্রণায় বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লকডাউনের পর ব্যাপক বেকারত্ব, আয় হ্রাস, খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত এবং মানবিক সহায়তার হ্রাস ঘটছে। গত বছর ৮২১ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। ১৪৯ মিলিয়ন মানুষ সংকট স্তরের ক্ষুধা বা এর চেয়েও খারাপ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। প্রতিবেদনে আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং দক্ষিণ সুদানসহ বিশ্বের ১০টি ক্ষুধার্ত ‘হটস্পটস’ প্রকাশিত হয়েছে। ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে থাকার মাত্রা বাড়ছে। এর আগে গত এপ্রিলে অক্সফাম জানিয়েছিল, করোনা মহামারি বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

চলমান কোভিড মহামারিতে অনেক কৃষক আর্থিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন। বাংলাদেশের মোট খাদ্য চাহিদার ৯৫ শতাংশের জোগানদাতা কৃষক। তাদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ৪৮ শতাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক পরিবার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, এপ্রিল ও মে মাস কৃষকের জন্য সবচেয়ে বড় মৌসুম; এই মৌসুমে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন কৃষিপণ্য বাজারে আসার কথা ছিল। কিন্তু চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে কৃষকের উৎপাদিত বেশির ভাগ ফসলই মাঠে নষ্ট হয়েছে। মহামারির মধ্যেও নাগরিকদের মানবাধিকারে গ্যারান্টি রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হয়। তাই করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে মানুষের খাদ্য অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সব অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কর্মরত শ্রমিককে সরাসরি খাদ্য ভর্তুকি দিতে হবে।

‘খাদ্য নিরাপত্তা’ হচ্ছে, খাদ্যের লভ্যতা এবং মানুষের খাদ্য ব্যবহারের অধিকারকে বোঝায়। কোনো বাসাকে তখনই ‘খাদ্য নিরাপদ’ বলে মনে করা হয়, যখন এর বাসিন্দারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় বসবাস করেন না কিংবা খাদ্যাভাবে উপবাসের কোনো আশঙ্কা করেন না। ‘নিরাপদ খাদ্য’ ধারণা শুধু খাদ্যবাহিত রোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ ধারণা আরো ব্যাপক হয়েছে। খাদ্য নিরাপদ না হলে শুধু তাৎক্ষণিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে না, বরং আরো দীর্ঘমেয়াদি রোগের সৃষ্টি করে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসংক্রামক রোগ; যেমনÑ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, ক্যানসার ইত্যাদি। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুদ রাখা, আকর্ষণীয় করাসহ নানাভাবে নিরাপদ না হলে যেকোনো মানুষ মরাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমান সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর ৬১ শতাংশ কারণ অসংক্রামক রোগ। কিন্তু অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধযোগ্য। এ রোগ জীবনযাপনের ধরন, তামাক সেবন এবং খাদ্যের অভ্যাসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

সমস্যা মোকাবিলায় এ মুহূর্তে যা করণীয় তা হলো, গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খাদ্য উৎপাদনকারীদের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে বাজার গড়ে তুলতে হবে। বিকেন্দ্রীকৃত পদ্ধতিতে কৃষিপণ্য বিনিময়ের সুবিধার্থে স্থানীয়ভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার স্থাপনে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত সুবিধার্থে ক্ষুদ্র কৃষক এবং ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের ছোট শহর এবং নগরকেন্দ্রগুলোতে প্রবেশের সুযোগ করে দিতে হবে। এটা করতে পারলে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে। সত্যিকারের কৃষক লাভবান হবেন। জাতীয় খাদ্য মজুদ জোরদার করতে হবে। খাদ্যের মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে বেশ কিছু কৌশলগত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। জাতীয় সংরক্ষণাগার স্থাপন ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার স্বার্থে সরকারকে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণে ধান-চাল ক্রয় করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টদের অভিমত গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকের মতামতও গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের মতামতে গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিজমি সুরক্ষার জন্য সরকার ‘কৃষিজমি সুরক্ষা এবং ভূমি ব্যবহার আইন (খসড়া)’ তৈরি করেছে। ২০১৯ সালের জুনে মতামত চাওয়া হয়েছিল। দুঃখজনকভাবে আইনটি এখনো খসড়াতেই থেকে গেছে। এখানে বেশকিছু ভালো প্রস্তাবনা আছে। আইনে রূপান্তর করা গেলে কৃষিজমিকে অকৃষিজমিতে রূপান্তর করা সহজ হবে না। অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে কৃষিজমি অকৃষিতে ব্যবহার রোধ করতে হবেই। জাতিসংঘ ২০১৯-২৮ সালকে পারিবারিক কৃষি দশক হিসেবে ঘোষণা করেছে। পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে পারিবারিক কৃষিতে বিনিয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় কৌশল প্রণয়ন করত হবে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। সব সময়ের অবহেলিত কৃষি খাতকে চাঙা করতে স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কঠোর ও আন্তরিক হতেই হবে।

ক্ষুধা ও খাদ্যের সঙ্গে জড়িত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এখানে অবনতি হতে পারে। সুকান্তের ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, চাঁদ যেন ঝলঝানো রুটি’ হতে পারে। ক্ষুধার সঙ্গে চুরি, ছিনতাই পরিস্থিতি নির্ভর করে। পেট শোনে না কোনো কিছু। ক্ষুধা অন্যায় বোঝে না। তাই মানুষের খাদ্য পাওয়ার অধিকারকে জোরালোভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যর্থতায় বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে খাদ্য সংকট অনেক বড় হুমকির কারণ হতে পারে। সামাজিক বেষ্টনীর মাধ্যমে সরকার অনেক প্রকল্প-কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এসব থেকে সর্বোচ্চ ইতিবাচক ফলাফল পেতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, বৈষম্যহীনতা, সমতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনদের ক্ষমতায়নে জোর দিতে হবে। সরাসরি অর্থ/সাহায্য কৃষকের কাছে পৌঁছাতে সরকার কাজ করছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও আন্তরিকতা দেখাতে হবে। একটা স্তরের ব্যর্থতা জাতীয় সমস্যায় ফেলতে পারে। এমন বিষয়ে সরকারকে অধিক সতর্ক হতে হবে। সবাই মিলে কষ্ট করি। প্রথম মানব হিসেবে চন্দ্রপৃষ্ঠে যখন নীল আর্মস্ট্রং পা দিলেন, বলেছিলেন... thats one small step for man, one giant leap for mankind (মানুষের ছোট ছোট পদক্ষেপ মিলেই মানবজাতির জন্য বড় কিছু)।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close