বাদল চৌধুরী

  ০৭ জুলাই, ২০২০

ব্যক্তিত্ব

মৃত্তিকালগ্ন সংস্কৃতিজন কামাল লোহানী

শুভ্রতার পল্লবে আবৃত কামাল লোহানী। ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সঙ্গে রয়েছে তার যুক্ততা। কাশফুলের মতো সাদা চুলের অধিকারী কামাল লোহানী কর্ম ও মননে ছিলেন তরুণ। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পোশাকেই দৃপ্ত পায়ে সম্মুখে এগিয়েছেন তিনি আর আমাদের দিয়েছিলেন আলোকবর্তিকা হয়ে পথের নিশানা। কামাল লোহানী আমাদের কীর্তিমান পুরুষ, যিনি কালের পরিক্রমায় নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।

বয়সের বেড়াজাল ছিন্ন করে আমাদের সখ্য এবং হৃদ্যতা হয়ে ওঠেছিল বন্ধুর মতোই সরল। তাকে আমি কামাল ভাই বলেই ডাকতাম, তিনিও আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। কামাল ভাই পদক্ষেপ বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। সেই সুবাধে তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। দিন তারিখ মনে নেই, কবে কখন কোথায় পরিচয়। তবে ২০০১ সাল থেকে নিয়মতি যোগাযোগ ছিল, যাতায়াত ছিল অবাধে। আর পদক্ষেপ বাংলাদেশ-এর উপদেশক হিসেবে কত-শত সহস্রবার যে জ্বালাতন করেছি তার ইয়ত্তা নেই। মৃত্তিকালগ্ন জনগণের সংস্কৃতি চর্চায় নিয়োজিত সহজ-সরল-সাদা মনের মানুষ কামাল ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তার অনুগামী হয়ে আমি কল্যাণের পথে হেঁটে চলেছি শিল্প-সৃজনে।

স্মৃতিরা বরাবরই আনন্দের আবার কষ্টেরও হয়। অনেক স্মৃতি হারিয়ে যায় অথবা ম্লান হয়ে যায় কিন্তু আমার স্মৃতিগুলো জীবনাকাশে ভেসে বেড়াবে স্বপ্নিল ডানা মেলে। তাই আজ হৃদয়াবেগে কিছু লিখতে হচ্ছে কামাল ভাইয়ের চলে যাওয়ায়।

২০১৬ সালে পদক্ষেপ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আয়োজন চলছে। আমাদের সংস্কৃতির বাতিঘর ও সংগঠনের উপদেষ্টা কামাল লোহানী উদ্বোধক। আমি কার্ড ছাপানোর আগে ফোন দিলাম। খুবই অসুস্থ আসতে পারবেন না। অন্য কাউকে যেনো উদ্বোধক করি, তবে এটাও বললেন শরীর ভালো থাকলে অনুষ্ঠানে আসবেন। কি আর করা, আমরা উদ্বোধক করলাম সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ভাইকে। এর মধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি কামাল ভাইয়ের সঙ্গে। অনুষ্ঠানের দিন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগে কামাল ভাই এসে হাজির। সামনের সারিতে অতিথিরা বসে আছেন অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। কামাল ভাইকে দেখে অনেকেই অবাক, কার্ডে নাম নেই; ভুল করে চলে এসেছেন হয়তো। আমি এগিয়ে গেলাম। কামাল ভাই বলল, বলেছিলাম না ভালো লাগলে আসব, তাই চলে এলাম। এ রকমই ছিলেন কামাল লোহানী। কুদ্দুছ ভাই হাত ধরে নিয়ে গেলেন আর বললেন, কামাল লোহানী ভাই থাকতে আমি কে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার? সেদিন আরো একবার শিখেছিলাম অগ্রজ-অনুজের আত্মিক বন্ধন কতটা দৃঢ় হলে এমনটি হয়। পথচলায় এ রকম হাজারও স্মৃতি রয়েছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না। নানা গুণে গুণান্বিত কামাল লোহানী। সবকিছুর আড়ালে একজন সংবেদনশীল মানুষ। বিনয় তার স্বভাবজাত।

কামাল লোহানী নামেই সমধিক পরিচিত হলেও পারিবারিক নাম তার আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। তাদের বসতি ছিল যমুনা পাড়ে। খাস কাউলিয়ায়। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাদের বাড়িঘর জমি-জিরাত চলে যাওয়ার পর তারা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আর এই সনতলা গ্রামেই ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন কামাল লোহানী জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৬ বছর বয়সে মাতৃহারা হন তিনি। একান্নবর্তী পরিবারে বাস হওয়ায় বাবা তাকে গ্রামে না রেখে পাঠিয়ে দিলেন নিঃসন্তান ফুফুর কাছে কলকাতায়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে চলে আসেন; এসে পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। থাকতেন ছোট কাকা শিক্ষাবিদ ও লেখক তাসাদ্দুক হোসেন খান লোহানীর কাছে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে; এখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।

পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের কজন সমমনা একজোট হয়ে বাঁধলেন জোট, নাম দিলেন ‘পাইওনিয়ার্স ফ্রন্ট’। লড়লেন কলেজ নির্বাচনে এবং নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেন। এই ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আর কামাল লোহানী তখন থেকেই উপস্থাপনা, গ্রন্থনা এবং আবৃত্তিতে অংশ নিতেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় পাবনা জেলা স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রাবস্থায় কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমনের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলায় পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষসহ কামাল লোহানী ও অন্যান্য সহযোদ্ধা গ্রেফতার হন। মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেফতার হন।

১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় সহসম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন হাতেখড়ি হলো সাংবাদিকতায়। সেই থেকে তার কলমের আঁচড়ে তৈরি হতে লাগল এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ১৯৫৫ সালে তিনি ন্যাপ-এ যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৫ সালে গ্রেফতার হলে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই জেলকক্ষে বন্দিজীবন কাটান। সেই বন্দি দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর সন্নিকটে আসেন এবং তার ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠেন।

১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী জড়িত হয়ে পড়লেন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। নৃত্যগুরু জি এ মান্নান প্রযোজনা করেন ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ তখন ছেলে চরিত্রে অংশ নেন কামাল লোহানী। ১৯৫৯ সালে এই নৃত্যনাট্য নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন তিনি। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যান এবং ইরান, ইরাক সফর করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালে রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’ গড়ে তোলেন। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্বে পূর্ববাংলার শিল্পীদের সঙ্গেও কামাল লোহানীও সর্বতোভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কালক্ষেপণ না করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নেন। এ ছাড়াও সংবাদ পাঠ, কথিকা লেখা ও প্রচার, ঘোষণা, সেøাগান দেওয়া ইত্যাদিতে কণ্ঠ দিয়েছেন।

কামাল লোহানীর পরিচয়ের কোনো শেষ নেই। তিনি একজন সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, অভিনেতা, আবৃত্তি শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী এবং সুলেখক নানা পরিচয়ে পরিচিত। কামাল লোহানী ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একুশের চেতনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীন বাংলা বেতার পরিষদের উপদেষ্টা, পদক্ষেপ বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা। ‘রাজশাহী আর্ট কলেজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। গণশিল্পী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সবকিছুর পাশাপাশি কামাল লোহানী ‘আমার বাংলা’ নামে শিল্প-সংস্কৃতি গবেষণা ও অনুশীলন চক্র গঠন করেন। ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন একনাগাড়ে চার বছর। ‘ব্রতচারী বাংলাদেশ’ এবং ‘নব নাট্য সংঘ’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে থেকে এবং শেষাবধি সভাপতি হিসেবে সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়ন ও জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিরলস কাজ করেছেন।

তার লেখা প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছেÑ ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারব না’, ‘সত্যি কথা বলতে কী’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এ দেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তি সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মতো’, ‘শব্দের বিদ্রোহ’, ‘ভাষা আন্দোলনের কথকতা’, ‘সাংবাদিকতার সাতকাহন’, ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’। এ ছাড়াও ঘটনাবহুল সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে তার নিজের কথা লেখ্যরূপে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে ‘অগ্রজের সঙ্গে এক দিন’।

তিনি ২০১৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়াও দেশ-বিদেশের বহু সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথি তারই চাচাতো বোন সমাজকল্যাণে মাস্টার্সপড়ুয়া সৈয়দা দীপ্তিকে ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন। কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়েÑ সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী। আমাদের সংস্কৃতির বাতিঘর, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ, প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, কামাল লোহানীর প্রয়াণে জাতি হারাল পরম বন্ধু ও অভিভাবক। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের অবসান হলো। শান্তিময় হোক তার অনন্তের পথে যাত্রা। তাকে বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close