সাধন সরকার

  ০২ জুলাই, ২০২০

বিশ্লেষণ

ভূমিকম্পে প্রস্তুতি ও সচেতনতাই মুখ্য

পৃথিবীতে যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছে তার মধ্যে ভূমিকম্প সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দুর্যোগ। ভূমিকম্পের আগাম পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব নয়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে আনতে পারে। গত ২১ জুন বিকালে ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশের পূর্বাঞ্চল ও ভারতের মিজোরাম রাজ্য। ১২ ঘণ্টা না পেরোতেই পরদিন ২২ জুন ভোরবেলা ভূমিকম্পে আবারও কেঁপে ওঠে চট্টগ্রাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব জরিপ বিভাগের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণের তথ্যানুযায়ী রিকটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৮। এর উৎসস্থল ছিল ভারতের মিজোরাম রাজ্যে। এর আগে গত ১৩ এপ্রিল রাতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের সিলেটের গোয়াইনঘাট এলাকায় এবং ২৫ মে ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফলে ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে সিলেট। সব মিলিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প হলো দেশের পূর্বাঞ্চলে। তথ্যমতে, এশিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলটি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, আশপাশের হাওর এলাকা ও যমুনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের নিচ দিয়ে চলে গেছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দিকে। এই অঞ্চলটিকে বলা হয় সাবস্ট্রাকশন জোন। এই জোনের মধ্যে বাংলাদেশসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যও রয়েছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই অঞ্চলের টেকটনিক প্লেটে বিপুল শক্তি জমা হয়েছে। এই শক্তি ছোট ছোট ভূমিকম্পের মাধ্যমে মুক্ত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। তবে এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্পের কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না! কেননা অনেক বড় বড় ভূমিকম্পের ইতিহাসও ভারতীয় উপমহাদেশে রয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে মাঝারি বা বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা! রাজধানী ঢাকায় ‘বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’ না মেনে ও জলাভূমি ভরাট করে নির্মিত এমন হাজার হাজার ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, আয়তন সেভাবে বাড়ছে না। ঢাকামুখী এই জনস্রোতের চাপের কারণে ঢাকা ও এর চারপাশে অনেক আবাসন প্রকল্প হয়েছে। শহর বৃদ্ধির এই মহোৎসবে নির্মাণকাজ ও মাটির গুণগত মানের চেয়ে জমির অবস্থান ও দামের গুরুত্ব যেন বড় হয়ে উঠেছে। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভবন আছে। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা গেছে, ঢাকা মহানগরের প্রায় সাড়ে তিন লাখ পাকা ভবনের মধ্যে প্রায় দেড় লাখ ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার ভবনে রড ব্যবহার করা হয়নি। কিছু কিছু বিল্ডিং আছে অনেক পুরাতন। নতুন ঢাকার বেশির ভাগ ভবন জলাভূমি ভরাট করে এবং পুরান ঢাকার বেশির ভাগ ভবন পুরোনো হওয়ায় পুরো ঢাকা শহরের বেশির ভাগ ভবনই কমবেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। প্রশ্ন হলো, ভবন নির্মাণের ফলে প্রাণহানির ঝুঁকি কেন? এটি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে; যেমন ভূমিকম্পের আগে যথাযথ ডিজাইন না করে তথা ভূমিকম্পরোধী ডিজাইন না করে ভবন নির্মাণ, নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানে অবহেলা, নি¤œমানের উপকরণের ব্যবহার, অননুমোদিত ফ্লোর বাড়ানো, দুর্বল মাটিকে শক্তিশালী না করে ও জলাভূমি ভরাট করে ভবন নির্মাণ ইত্যাদি। ভূমিকম্পের পরেও প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। এটা হতে পারে ভবনের চারদিকে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকা এবং সরু রাস্তা, অপ্রতুল সরঞ্জাম ও উদ্ধারকাজে পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞানের অভাব ও অসচেতনতা। দুঃখের বিষয়, ঢাকা শহরের ঘিঞ্জি অলিগলিতে একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও তাৎক্ষণিক প্রবেশ করতে পারে না! অবহেলা ও অপ্রস্তুতির কারণে যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে! যেকোনো ভূমিকম্পে প্রস্তুতিই হলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। পূর্বে মনে করা হয়েছিল, ঢাকা কখনো ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হবে না! কিন্তু বিভিন্ন সময় ঢাকা অঞ্চলও ভূমিকম্পের উৎসস্থল হয়েছে। নরম মাটিতে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। ঢাকার সরকারি অনেক ভবনও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে! ঢাকার এই ঝুঁকির কারণ যতটা না ভূতাত্ত্বিক, তার চেয়ে বেশি অবকাঠামোগত।

পুরো বাংলাদেশকে ৩টি ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা রয়েছে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। তবে ছোটখাটো ভূমিকম্প ঢাকা শহরকে মাঝেমধ্যে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে! ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারিতে ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফলে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশে এর মাত্রা তুলনামূলক কম হলেও (প্রায় ৫ মাত্রার) এতে ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো কেঁপে ওঠে। এতে রাজধানীর ৪টি ভবন হেলে পড়ে এবং ৬ জন মারা যায়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঢাকা কিংবা এর আশপাশে যেকোনো একটি চ্যুতিতে (যেমন টাঙ্গাইলের মধুপুর বা সিলেট চ্যুতিতে) ছয়-সাত মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে রাজধানীর প্রায় ৭২ হাজার ভবন পুরোপুরি ভেঙে পড়বে! এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিরসন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। ১. যে ভবনগুলো তৈরি হয়ে আছে, সেগুলো রেট্রোফিটিং-এর মাধ্যমে কিংবা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলা। ২. বর্তমানে যে ভবনগুলো গড়ে তোলা হবে, সেগুলো যথাযথ ‘বিল্ডিং কোড’ ও ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি করা।

একটা ছোট-মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার পর সবাই নড়েচড়ে বসে। সরকার থেকে প্রস্তুতি ও সচেতনতার কথা বলা হয়, মিডিয়ায় দু-এক দিন লেখালেখি হয়, জনসাধারণের মুখে ঘটনার বিবরণ দু-এক দিন থাকে। তারপর আবারও সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়! ভুলে যায় ভূমিকম্পের প্রস্ততি কতটা আছে, প্রস্তুতি ও সচেতনতা কেমন হওয়া দরকার ছিল। আমরা এটা ভাবী না যে, আজ যে ছোটখাটো ভূমিকম্প আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে, এটা কোনো বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে! এক রানা প্লাজা ধসের পর তার উদ্ধারকাজে দীর্ঘসময় লেগেছিল। আর উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে তার উদ্ধারকাজে কী হাল হবে তা সহজেই অনুমেয়! রাজধানী ঢাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক অতিরিক্ত ভবন নির্মাণ তৈরি করা হয়েছে। এ কারণেই ঢাকার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে। যে দুর্যোগটি রোধ করার উপায়ই মানুষের হাতে নেই তার জন্য আগাম প্রস্তুতি ও সতর্কতা ছাড়া আর কিবা করার আছে! ভূমিকম্পের সময় ও পরে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে জনগণের মধ্যে ধারণা ও সচেতনতা থাকা জরুরি। ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনিতে কী করতে হবে, ঘর থেকে বের হতে না পারলে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে ইত্যাদি সচেতনতা নগরবাসীর মধ্যে তৈরি করা দরকার। আর সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ভূমিকম্পের সতর্কতার মহড়া ও প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। মনে রাখা দরকার, ভূমিকম্পে মানুষ মরে না, অসচেতনতাই মানুষের মৃত্যু ঘটায়! প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়, তবে সচেতনতার বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। এ ছাড়া বিভিন্ন ভূমিকম্পপ্রবণ জেলা শহরে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা দরকার। আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে ফায়ার সার্ভিসকে শক্তিশালী করা, জনসচেতনতা তৈরি করা ও প্রচার-প্রচারণাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলে বড় ধরনের ভূমিকম্পেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

লেখক : পরিবেশকর্মী ও কলামিস্ট

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close