মো. কায়ছার আলী

  ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

মতামত

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং...

‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা, পুরে কি আশা?’ মাতৃভাষা সমাসবদ্ধ পদ। ব্যাকরণের দিক দিয়ে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। অভিধানে লেখা আছে স্বদেশের ভাষা। ভাষা খেলা করে জিবের ডগায়। ঘোষিত হয় গলার মধ্য দিয়ে। প্রাণ লাভ করে ফুসফুসে। আসলে ওর জন্ম বুকের মধ্যে। উৎস মানুষের মন। আমাদের মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারি, মনসার দর্পচূর্ণকারী আরাকানের রাজসভায় মনিময় অলঙ্কার। বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহ্বান। মাইকেল মধুসূধন দত্ত, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষা আমার মাতৃভাষা, আমাদের মাতৃভাষা, বাঙালির মাতৃভাষা। প্রতিটি শিশুর জন্য মায়ের দুধ যেমন পুষ্টিকর; ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য মাতৃভাষা পুষ্টিকর। ভাষা যেকোনো জাতির সৃজনশীল ধীশক্তির অপূর্ব সৃষ্টি। জাতির মেধার অনন্য লালন ক্ষেত্রে। জাতির মননের আকর্ষণীয় স্থাপত্য। সারা বিশ্বে প্রায় সব ক্ষেত্রে ভাষার ভুমিকা এ রকমই হয়ে থাকে। মহান একুশে ফ্রেরুয়ারি বাঙালির ভাষার মাস। শুধু বাংলা ভাষাই নয়। পৃথিবীর ছোট-বড় সব জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা আর গুরুত্ব তুলে ধরার মাস। কৃষ্ণচূড়ার রক্তলালে রাঙানো বসন্তে আবার ফিরে এসেছে সেই ফেব্রুয়ারি মাস। মাতৃভাষাকে চির অমøান করে একটা সংগ্রামের জাগ্রত চেতনার মাস। একটা লাল তারিখের অণু-পরমাণুতে গড়া নবচেতনার মাস, জীবন দর্শনের মাস। স্বার্থসিদ্ধির কালো মেঘের বক্ষ বিদীর্ণ করে সূর্য ওঠার মাস। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবি তথা বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপানের মাস। আর্থসামাজিক অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতির তার সব বঞ্চনাকে এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মূর্ত করতে চায়। ফলে দেখা যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার পরও এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে শহিদ দিবস ও শহীদ মিনারের আবেদন এতটুকু কমেনি। ইতিহাস গড়ে উঠে, ইতিহাস রচিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস এমনিভাবে প্রাণ পেয়েছে যদিও তার প্রতি বাঁকে বাঁকে রয়েছে নির্মল রক্তকণিকার মণিমুক্ত। পাকিস্তানের শাসকরা বাংলা ভাষাকে কোনো দিন সুনজরে দেখেনি। তাদরে বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, বাংলা হিন্দুর ভাষা, হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাই শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করল। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান গণপরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে একটি ‘মূলনীতি কমিটি’ গঠন করেন এবং পাকিস্তানের সংবিধান রচনার মৌল বিষয়বস্তু নির্ধারণের ভার এ কমিটির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৫০ সালে মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকশিত হয়। এই রিপোর্ট পূর্ব বাংলার জনমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার নেতারা এত দিন যা দাবি করে এসেছে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তার কোনোটিতে তা স্থান পায়নি। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হস্তে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। তিনি ঢাকায় এসে ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে ভাষার প্রশ্নটি আবার উত্থাপন করেন এবং পল্টন ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তিটি আবার ঘোষণা করেনÑ ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এবার কিন্তু প্রতিবাদের ঝড় তুমুল আকার ধারণ করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক পরিষদের আসন্ন অধিবেশন সামনে রেখে দেশব্যাপী আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেন। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে কয়েকটি পথসভা, পতাকা দিবস পালন এবং সর্বত্রই জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা জনগণের ভাষার এই মৌলিক দাবিটি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে তা ব্যাপকভিত্তিক এক আন্দোলনের পত্তন করেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এ আন্দোলনকে চেয়েছিল বানচাল করতে। যদিও আন্দোলনের যৌক্তিকতা ছিল সন্দেহাতীত। পাকিস্তানের শতকরা আটজন উর্দুতে কথা বলে। অথচ তা হবে রাষ্ট্রভাষা এবং যে ভাষার দেশের শতকরা ৫৬ জন লোক কথা হলে, তা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করবে নাÑ এ যুক্তি একমাত্র নির্বোধ ছাড়া সবাই বোঝে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ছিল বলদর্পী ও ক্ষমতালোলুপ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি হরতালকে বানচাল করার জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রফিক, জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ অকালে ঢলে পড়ল, ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হলো এবং সবকিছুই শুধু মাতৃভাষার দাবিতে। পরবর্তী ১৯৫৩ সালের কমিটির রিপোর্টের আলোকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে মর্যাদা দানের সুপারিশ করা হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দুর সঙ্গে বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে আমাদের মাতৃভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ আরো ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। লেখক, কবি, সাহিত্যিক. দার্শনিক প্রমুখ প্রত্যেকে মাতৃভাষায় তাদের কাব্য, সাহিত্য ও মতবাদ রচনা করেছেন এবং সম্মানিত হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় বাংলা ভাষায় লিখে আবার সম্মানিত হয়েছেন। বর্তমানে পৃথিবীতে ৬৭০০-এর ওপরে ভাষা আছে। বর্তমান শতকে অধিক ভাষা হারিয়ে যাবে অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে একটি ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। আমরা চাই, আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা দিনে দিনে আরো সম্প্রসারিত হোক। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলা ভাষার অনেক উন্নতি বা পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান সরকারের দক্ষ এবং আন্তরিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর সদর দফতরে সাধারণ অধিবেশনে ভাষাশহিদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাকে যথার্থ স্থানে স্থান দেওয়ায় ১৮৮টি দেশের সমর্থনে সারা বিশ্বে আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ বলা যাবে না, যারা সেদিন ভাষাশহিদদের বুকে গুলি চালিয়েছিল। তাদের দেশেও আজ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক একটি অর্জনের কথা লিখছি। নিউইয়র্ক সিটির ১৮০০ পাবলিক স্কুলে বাংলা শিশুদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১১ লাখ স্কুল ছাত্রছাত্রীর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় সুযোগ পাবে। নিজেদের বাবা-মায়ের ভাষার সঙ্গে আরো সুন্দরভাবে পরিচিতি হওয়ার সুযোগ মিলবে। এজন্য অভিনন্দন জানাই নিউইয়র্ক স্কুল চ্যান্সেলর কংগ্রেসম্যান নিদিয়া ভ্যালেসকুয়েজকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে যে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল এবং পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের শহিদ শফিউর রহমানের গর্বিত বাবার হাতে উদ্বোধনের পর আজ সেই ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি চির প্রবহমান নদীর ধারার মতো দেশ ও বিদেশে অবস্থিত সব শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভে আবালবৃদ্ধবনিতার মাধ্যমে ফুলে ফুলে বা ভালোবাসার মালায় মালায় সিক্ত হয়ে শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে ভরে উঠেছে। আর অন্তরের অন্তস্তল হতে হৃদয়ের সব অনুভূতি দিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এবং প্রয়াত সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে কালজয়ী গানটি দলে দলে গাইছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি।’

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close