ইসমাইল মাহমুদ

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বিশ্লেষণ

জলাশয় রক্ষাই আজ সময়ের দাবি

দেশে অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কাটা ও জলাশয় ভরাটের প্রতিযোগিতা। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত ও বিপন্নের পথে রয়েছে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে না পারলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে প্রাণিকুলÑ এ রকম ধারণা প্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্রমশ ধ্বংস হওয়ায় দেশের ১৫০ প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ও সরীসৃপ প্রজাতি। এসব বন্যপ্রাণীর বেশির ভাগ এখন অতি বিপন্ন, বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২৫০ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সঠিক অবস্থান সম্পর্কে রয়েছে যথার্থ তথ্য-প্রমাণের অভাব। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিবেশগত অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা নিরাপদ রাখা এবং পরিমার্জিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণীত না হলে উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ইতোমধ্যে দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে গন্ডারের তিনটি, বনগরুর দুটি, হরিণের দুটি, পাখি প্রজাতির দুটি, নেকড়ে, বনমহিষ, নীলগাই এবং এক প্রজাতির সরীসৃপ। বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৪৭ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ। গবেষণার তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৯০৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩০-৩৫টি উভচর, ১২৬টি সরীসৃপ, ৬৫০টি পাখি এবং ১১৩টি স্তন্যপায়ী প্রজাতি রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে ইতোমধ্যে ১০টি প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। এ ছাড়া ৪৩টি প্রজাতি রয়েছে বিলুপ্তির পথে। বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে লজ্জাবতী বানর, পারাইল্টা বানর, কুলু বানর, উল্লুুক, রামকুত্তা, গেছোবাঘ, চিতা বাঘ, উদবিড়াল, ভল্লুক, শূকর, বনছাগল, সেম্বার, বনরুই, মুখপোড়া হনুমান, বনবিড়াল, মেছোবাঘ, কাঁকড়াভুক বেজি, ভোঁদড়, কালো ভল্লুক, বাঘডাশ এবং মায়াহরিণ। বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে লালসির হাঁস ও ময়ূর। অতিবিপন্ন পাখির তালিকায় রয়েছে কালো তিতির, কাঠময়ূর, বাদিহাঁস, বাঞ্চাহাঁস, রাজধনেশ, পাহাড়ি ঘুঘু, হড়িয়াল, কোরাল, লালশির শকুন, হাড়গিলা, পাহাড়ি ময়না, মথুরা, কাওধনেশ, ঈগল প্যাঁচা, হট্টিটি, সাদা উগল, মাদল টাক প্রভৃতি। এ ছাড়া উভচর প্রজাতিতে পটকা, সবুজ ও গেছোব্যাঙ এখন বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দেশের প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ না করা গেলে দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে আরো বহু প্রজাতির প্রাণী ও পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিলে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী ও পাখির প্রজনন বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপন্নতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, ব্যাপক হারে বন উজাড়, অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার, নদীর নাব্য হ্রাস ও ভারসাম্যহীন পরিবেশ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপন্ন আর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশ সংরক্ষণ-বিষয়ক আইন, বিধি ও অধ্যাদেশ থাকা সত্ত্বেও যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপন্নপ্রায়। এতে বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি ও ক্রমহ্রাসের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে সভ্যতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কেউ যদি প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে মানবসমাজ ও সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার কথা চিন্তা করেন, তাহলে তিনি যে কেবল বোকার স্বর্গেই বাস করছেনÑ এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করেই মানুষ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আজ ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার ব্যাপক উল্লম্ফনের ফলে মানুষের হাতেই প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। আর এধারা অব্যাহত থাকলে একসময় পৃথিবী আর মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না বলেই অনেকের বিশ্বাস।

তবে শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ নয়; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপন্ন প্রাণিকুল রক্ষাকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। দেশের বিভিন্ন বন ও জলাভূমিতে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। তাদের কাজ এখনো খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে নয়। বিপন্ন প্রাণিকুল রক্ষাকল্পে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সভা-সেমিনার, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা, প্রতি জুমার দিনে মসজিদে বয়ান এবং পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে রক্ষা পাবে পাহাড়, বন ও জলাশয়; কিছুটা হলেও বাঁচবে বন্যপ্রাণী। রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবুজ প্রাণবন্ত পরিবেশ-প্রতিবেশ।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close