কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম ও মোহাম্মদ জাকির হাসনাৎ

  ২১ আগস্ট, ২০১৯

পর্যবেক্ষণ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলার কৃষি

স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের কৃষি ছিল মান্ধাতা আমলের ও একান্তই প্রকৃতিনির্ভর। বন্যা, খরা, রোগবালাই, অনুন্নত বীজ ও উৎপাদন প্রযুক্তি, উপকরণ স্বল্পতাÑ এসব বহুমাত্রিক সংকটে জর্জরিত। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টির কারণে প্রকৃতিনির্ভরতা কমিয়ে উন্নত জাত, উপকরণ, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল সহায়তায় আধুনিক কৃষির সূচনা হয়। তাঁর সবুজ বিপ্লব, কৃৃষি বিপ্লব ও দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষিতে আসে গতিশীল পরিবর্তন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নিদারুণ ধ্বংসস্তূপের ওপর সর্বাগ্রে ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ দেশে শক্তিশালী কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণ সরবরাহের বুনিয়াদ রচনা করেছিলেন। কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের চেতনায় এঁকে দিয়েছিলেন স্বপ্নসৌধ। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, কোনো জাতি বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না, যদি লক্ষ লক্ষ টন খাবার ভিক্ষা করতে হয়, বিদেশ থেকে আনতে হয়। দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাল কিনতে পারছি না, চাল যদি খেতে হয় আপনাদের পয়দা করেই খেতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এই দৃঢ়প্রত্যয় কৃষি বিপ্লব তথা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে তার দূরদৃষ্টি ও আন্তরিকতারই পরিচায়ক। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে আর বই পড়েই কৃষিকাজ হয় না। ছোট ভাইয়েরা তোমরা মনে কিছু করবে না। বই পড়ে তোমরা যা শিখ, গ্রামে যারা অর্থাৎ বুড়া কৃষকরা নিজের অভিজ্ঞতায় কম শেখে না। যদি তাদের জিজ্ঞেস করো এই জমিতে কী লাগবে, কতটুকু সার লাগবে, সে নির্ভুল বলে দিতে পারবে। তোমরা ৫ বছর বই পড়ে যা শিখবে না, তার কাছে দেখ উত্তর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে। বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু প্র্যাকটিকেল করতে হবে।’ ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে ‘কেমন বাংলাদেশ চাই?’ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে। তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের মর্মকথা হলো উৎপাদন বাড়াও। কৃষকরাই দ্বিতীয় বিপ্লবের অগ্রসৈনিক। কৃষির উন্নতি-অবনতির সঙ্গেই ওঠানামা করে দেশবাসীর সুখ-দুঃখের পারদ, দেশের অর্থনৈতিক কম্পাস। খাদ্যের জোগান এবং শিল্পের সম্প্রসারণ উভয়ই পুরোপুরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য আমদানি করতে হলে টান পড়ে বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের অভাবে কল-কারখানার উৎপাদন কমে যায়। উন্নত জাত ও পরিচর্যার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন তিন গুণ বাড়ানো সম্ভব। এটা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যেমনÑ চাকরির ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেন। এতে মেধাবীরা কৃষিশিক্ষায় এসেছে এবং শিক্ষা শেষে গবেষণা ও সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন সেক্টরে প্রবেশ করে আমূল পাল্টে দিয়েছে পুরাতন কৃষির। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে কৃষি আজ উৎপাদন সাফল্যে ভাস্বর। প্রতিটি বসতবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উৎপাদন কর্মকান্ড। একসময়ের দামি মাছ আজ পুকুরে উৎপাদিত হয়ে আস্বাদিত হচ্ছে গরিবের মুখে। গ্রীষ্মকালেও উৎপন্ন হচ্ছে শীতের সবজি। আমদানি নয়, দেশে উৎপাদিত মোটা চালে উদর পূর্তি হচ্ছে গরিবের। দেশের দুগ্ধখামার ও পোলট্রিশিল্প বিকশিত হয়ে মিটাচ্ছে প্রোটিন চাহিদা। কৃষিবিদদের মেধা ও শ্রমেই এসব সম্ভব হয়েছে। আর কৃষিবিদদের মেধাচর্চার এই ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুই নির্মাণ করেছিলেনÑ বঙ্গবন্ধুর মহান দান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি জ্ঞান আহরণের জন্য তিনি কৃষিবিদদের দুটি ব্যাচ রাশিয়া পাঠিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। এ কাউন্সিল কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা ও মূল্যায়ন করেন। ১৯৭৩ সালে ব্রি অ্যাক্ট পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। প্রতিষ্ঠানটি ৬টি হাইব্রিডসহ ৯৭টি জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য এনেছে। কৃষি গবেষণার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে ৩২নং জারীকরণ। এই অধ্যাদেশ বলে কৃষি গবেষণার উন্নয়ন ও সমন্বিত কার্যক্রমের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নং ৬২-এর মাধ্যমে ‘ডাইরেক্টরেট অব এগ্রিকালচার (রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন)’ বিলুপ্ত হয় এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ১০৪৪টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ১৯৭২ সালে পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে ঢাকায় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বা বিনা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯৭৫ সালে তা ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হয়। এ প্রতিষ্ঠান ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ১০৭টি জাত উদ্ভাবন করেছে। বীজ মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে ১৯৭৪ সালে বীজ প্রত্যয়ন সংস্থা (বর্তমান বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি) স্থাপন করেন। মৃত্তিকা গবেষণা ল্যাবরেটরি সমৃদ্ধ করে কৃষিজমির উর্বরতা রক্ষার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। সম্প্রসারণ সেবাকে গতিশীল করতে ৬টি সেক্টরে ভাগ করেন। যেমনÑ পাট উৎপাদন পরিদফতর, উদ্ভিদ সংরক্ষণ পরিদফতর, বীজ-উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড ও তুলা উন্নয়ন বোর্ড। প্রতি ইউনিয়নে একজন করে এক্সটেনশন এজেন্ট থাকা সত্ত্বেও আরো একজন করে গ্রাম সম্প্রসারণ কর্মী নিয়োগ দিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন তৎকালীন চিনিকল সংস্থা ১৯৭৪ সালে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে, যা বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ সুগার ক্রপস ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে কৃষকের হয়রানি থেকে মুক্তি দেন। পাটশিল্পের ওপর গুরুত্বারোপ করে স্বতন্ত্র পাট মন্ত্রণালয় স্থাপন করেন। আখশিল্পকে জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনকে প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। সেই সঙ্গে ভোজ্যতেল, চিনি, সার, ওষুধ, কৃষি সরঞ্জাম ও সুতি বস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। বিনামূল্যে কীটনাশক, স্প্রে মেশিন ও স্বল্পমূল্যে সার, বীজ সরবরাহ করা হয়। সেচব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের শুষ্ক মৌসুমে কৃষকদের মাঝে ৩৫ হাজার বিদ্যুৎ চালিত পাম্প, ৪ হাজার অগভীর নলকূপ ও ২ হাজার ৫০০ গভীর নলকূপ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে বিনামূল্যে কৃষকদের চালকসহ পাওয়ার পাম্প সরবরাহ করা হয়। শুধু নিজস্ব জ্বালানি ব্যয়ে কৃষকরা তা ব্যবহার করতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ৯১টি হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন এবং সাভার ফার্মের উন্নয়ন সাধন করেন। দেশের সব বাজারে মৎস্য চালান দেওয়ার জন্য যুগোস্লাভিয়া থেকে বিনিময় চুক্তিতে রেফ্রিজেরেটর আনা হয়। একক মালিকানায় সর্বোচ্চ জমির পরিমাণ ১০০ বিঘা নির্ধারণ করে অতিরিক্ত জমি ও খাসজমি মিলিয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার একর জমি ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন করা হয়। নোয়াখালী, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও দিনাজপুর জেলায় বন্যা স্কিমের আওতায় ১৭ মাইল দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ ও ২৬ মাইল খাল খনন করা হয়। এতে ২০ লাখ লোক উপকৃত হয় ও ৫ লাখ মণ ধান বেশি উৎপন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যশোরের সাতাসবিলে কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে ১০ ফুট প্রশস্ত সাড়ে ৪ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে জাপান সফরে যান। জাপান সফরকালে তিনি মাঠপর্যায়ের জাপানিজ কৃষকদের জন্য প্রচারিত রেডিও জাপানের কৃষিবিষয়ক আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের কার্যকারিতা ও সাফল্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। সেই উপলব্ধি থেকে জাপান সফর শেষে ফিরে এসে তিনি বাংলাদেশ বেতারের সব কেন্দ্র থেকে জাতীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আঞ্চলিক অনুষ্ঠান প্রচার করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আজ ঢাকাসহ ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন ২৯০ মিনিটের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কৃষির উন্নতির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। তাই তিনি কৃষি বিপ্লব, সবুজ বিপ্লব ও দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশও বিশ্বমানের হতো যদি তিনি বেঁচে থাকতেন এবং তার সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশ চালাতে পারত। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসেই কৃষি উপকরণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক সাফল্য সূচিত হয়। দেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের খাদ্য ঘাটতি ছিল ৩০ লাখ টন। বর্তমানে লোকসংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে প্রায় ১৭ কোটি হয়েছে। আবাদি জমিও সংকুচিত হয়েছে। অথচ দেশ দানাদার খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর অনুসরণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সততা, আন্তরিকতা ও কৃষকদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ উৎসারিত কৃষিবান্ধব নীতি কৌশল এবং কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ ড. মো. আবদুর রাজ্জাকের জ্ঞানসাধনায় খাদ্যে স্বয়ম্ভরতার ঊর্ধ্বগতি বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার, বাজেট ও বাস্তব পদক্ষেপ যেমনÑ ভর্তুকি, হ্রাসকৃত মূল্যে সারসহ উপকরণ সহজলভ্যকরণ, কৃষিঋণ বিতরণ, ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, ই-কৃষি বিস্তার, কৃষি যান্ত্রিকীকরণÑ এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর সময় এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার ইতঃপূর্বে ও বর্তমান সময়েও সর্বোতভাবেই কৃষিবান্ধব সরকার। সুতরাং বাংলাদেশের কৃষিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান এক কথায় অনবদ্য, অবিস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close