অরিত্র দাস

  ১৯ জুলাই, ২০১৯

জিজ্ঞাসা

ওরা কি ঘরেই বন্দি থাকবে

কোমলমতি মেয়েশিশুরা তো ছোট ছোট রঙিন প্রজাপতি। বেণি দুলিয়ে প্রজাপতির মতো নেচে নেচে বেড়ায়। মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তো আমাদের প্রজাপতি মেয়েশিশুগুলো ঘরের চৌকাঠ পেরুবে না। বাড়ির উঠোনে খেলতে যাবে না। বাড়ির ছাদে উঠবে না। রাস্তা দিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে স্কুলে যাবে না। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে বিস্কুট কিনতে যাবে না। পরিচিত কারো কাছে আধো আধো মুখে চকলেট খাওয়ার বায়না ধরবে না। দুষ্টুমির ছলে কারো বাগানে ফল খেতে যাবে না। লিফট বেয়ে এ তলা থেকে ও তলা উঁকি মারবে না। প্রতিবেশীর ঘরে যাবে না। শিক্ষকের কাছে অঙ্ক বুঝতে চাইবে না। পরিবারের ঘনিষ্ঠ কারো হাত ধরে ঘুরতে যাবে না কোমলমতি শিশুগুলো। হাসপাতালের বারান্দায় নিজের খেয়ালখুশি মতো হেঁটে বেড়াবে না। ট্রেনে চড়বে না। চার দেয়ালের মধ্যে তাদের জীবনটা বিষিয়ে উঠবে। তবে কি প্রজাপতি মেয়েশিশুগুলো ঘরেই বন্দি থাকবে? আর যদি তাই হয়, তা হলে তো ওদের জীবনে কোনো রঙিন শৈশব, স্বপ্ন, আহ্লাদ, ইচ্ছা, দুষ্টুমি থাকবে না। জীবন হয়ে উঠবে অথর্ব বস্তুর ন্যায় নিষ্ক্রিয়। কিন্তু ঘরের চৌকাঠ পেরুবে বা কোন সাহসে? বাইরে যে শকুন তার ছোট্ট শরীরটাকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য ওত পেতে আছে। পুরুষরূপী শকুন। ওদের একমাত্র নজর নারী মাংসের দিকে। হোক সে ফুলের কুড়ি কিংবা ফুল। তাতে কি আসে-যায়! মেয়ে তো। এই পুরুষরুপী শকুনদের লালসাপূর্ণ থাবায় সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থানে আছে এখন শিশুরা। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন গণমাধ্যম এবং প্রিন্ট পত্রিকায় অক্ষরজুড়ে ঘুরে ফিরে একের পর এক খবর ধর্ষণ। শিশু ধর্ষণ। ছাত্রী ধর্ষণ। বাংলাদেশে আর কজন শিশুর বা ছাত্রীর শরীরে এখনো বিষদাঁত বসেনি, বলতে পারো? সাত বছরের সিগ্ধ ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়ে। প্রজাপতির মন তার। এখনো সে বুঝতে শেখেনি, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে মানুষ নয়, সে মেয়ে। সে বুঝতে শেখেনি, তার চারপাশে ধর্ষক বাস করে। সে এও জানে না এই দেশটিতে ভালো মানুষের লেবাস লাগিয়ে অধিকাংশ ধর্ষক এখানে-সেখানে হেঁটে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে ভালো মানুষটি নিমেষেই ধর্ষক বনে যায়। রাজধানী সিলভারডেল স্কুলে নার্সারিতে পড়ত মেয়েটি। মেয়েটি অ আ ক খ ভালো করে শিখে উঠতে পারেনি এখনো। কিন্তু সেদিন হয়তো সে শিখে ফেলেছিলÑ এই ধর্ষণ উপত্যকায় তার জন্ম। তার জন্ম হয়েছে দেশের অন্ধকার সময়ে। যে সময়ে শিশু ধর্ষণ আগুনের ফুলকির মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ফুলকি তেঁতুল কাঠের আগুনে সৃষ্ট, সহজে নিভবে না। ওই আগুনে পুড়ে কয়লা হতে হয়েছে সত্য ও সুন্দরের প্রতীক সামিয়া আফরিন সায়মাকে। প্রতিটি শিশুই স্বর্গজাত সৌন্দর্যের প্রতীক। প্রতিদিনের মতো সেদিনেও শায়মা বিকালে খেলার জন্য বের হয়। খেলার সঙ্গী আজ খেলবে না বলে বাসায় ফিরে আসবেÑ এমন সময় তার ঘরে ফেরার পথে কাল হয়ে দাঁড়ায় ধর্ষক। সায়মাকে ছাদ ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে লিফট থেকে ছাদে নিয়ে যায় সে। অথচ কী করুণ, কী নিদারুণ পরিস্থিতি। ছোট্ট স্বচ্ছ নিষ্পাপ প্রজাপতি মেয়েশিশুটি বুঝতেই পারল না, সে একজন ধর্ষকের সঙ্গে ছাদ দেখতে আসছে। সে বুঝতে পারল না একটু পরে তার মৃত্যুর কারণ হবে এই ধর্ষক। সেখান থেকে নবম তলায় নিয়ে গিয়ে প্রথমে সায়মাকে ধর্ষণ করা হয়। তারপর তাকে শ^াস রোধ করে হত্যা করা হয়। মুহূর্তেই পৃথিবী থেকে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগে ঝরে যায় পদ্মফুলটি। সায়মার এমন গাঢ়মূল বিশ^াসে যে আঘাত করেছে, তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৩০টি। ধর্ষণ এবং ধর্ষণচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭ থেকে ১২ বছরের শিশু। অন্যদিকে ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, চলতি বছরের ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। কী ভয়ংকর কথা! ইউক্রেনে ২০১৭ সালে ৩২০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। তবে কি এই বাংলাদেশ আতঙ্ক-রাজ্যে পরিণত হচ্ছে? এভাবে যদি চলতে থাকে তবে আগামী দিনগুলোতে আমাদের মেয়েরা, হোক সে শিশু বা কিশোরী নয়তো যুবতী, ঘরের বাইরে যেতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। পুরুষের সঙ্গে সাধারণত মিশতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। ভয় পাবেÑ বোধহয় এই ছেলেটিই হতে পারে একজন ধর্ষক। ভাববে, পাশের বাড়ির করিম চাচা যদি ধর্ষণ করে। বাজারের গণেশ দা যদি ধর্ষণ করে। যদি স্কুলের শিক্ষক ধর্ষণ করে। যদি বাড়ির দারোয়ান ধর্ষণ করে। যদি আমার কন্যাকে বাইরের কোনো কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ ধর্ষণ করে। আমার কন্যাকে হত্যা করে। আমার মেয়ের প্রজাপতির জীবন মুখ থুবড়ে পড়ে মাটিতে। এই ভয়গুলো থেকে তৈরি হবে নতুন অসহিষ্ণু পরিবেশ। যে পরিবেশে আমাদের স্নেহশীলা অভিভাবকরা তাদের কন্যাসন্তান বাইরে ছাড়তে ভীত-সংকুচিত পায়রার ছানার মতো কেঁপে উঠবে। পাশাপাশি আমাদের কন্যারা বাইরে যেতে শঙ্কিত হবে। অন্যদিকে কোনো যুবক শিশুকে কোলে নিতে ভয় পাবে। আদর করতে ভয় পাবে, পাছে যদি কোনো অপ্রীতিকর বদনামের ভাগী হতে হয়। বৃদ্ধা তার স্নেহের হাত কোনো কিশোরীর পিঠে রাখতে কুণ্ঠিত হবে। কোনো পুরুষ নারীর সহচর্য প্রত্যাশা করতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে। এমন পরিবেশ আমরা চাই না।

ইউক্রেনের সরকার এ বছরের চলতি মাসে ব্যতিক্রমী এক আইন পাস করেছে। কেননা প্রতি বছর ইউক্রেনে শত শত শিশু যৌন নিপীড়নের ভেতর দিয়ে যায়। তাই দেশটিতে শিশুর ধর্ষককে এখন থেকে ইনজেকশন দিয়ে নপুংসক করা হবে। ওই ইনজেকশন দিলে ধর্ষক কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। তবে কোনো অপরাধী যদি জেলে থাকে, তাকে ইনজেকশন দেওয়া হবে না। প্যারোলে ছাড়া পাওয়ার পর তার শরীরে এটি পুশ করা হবে। এর আগে গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা রাজ্যে একই ধরনের আইন পাস হয়। সেখানে ১৩ বছরের কম বয়সি শিশুকে ধর্ষণ করলে এই শাস্তির আওতায় পড়ে একজন অপরাধী। যখন কোনোভাবেই শিশু ধর্ষণ কমানো যাচ্ছে না; তখন এ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলতে হবে বিচার ব্যবস্থার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close