মোতাহার হোসেন

  ২৫ জুন, ২০১৯

পর্যালোচনা

সমৃদ্ধির মেগা বাজেট বাস্তবায়ন জরুরি

বাজেট হচ্ছে একটি দেশের পরবর্তী বছরের উন্নয়নের রোডম্যাপ বা রূপরেখা। এই বিবেচনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রণীত বিগত দিনের বাজেট এবং বাজেট মূল্যায়নে ও বাস্তবায়নে এ সত্যের প্রতিফলন পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটু ঘুরিয়ে নিজেও বলেছেন, দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য যে যুদ্ধ, সেটিই সোনালি যুদ্ধ। এই যুদ্ধ জয়ী হওয়ার জন্যই প্রস্তাবিত এ বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যেই জনকল্যাণমূলক বাজেট। এ বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছানোই তার সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষ খুশি কি না, তা দেখতে হবে। এটা আমাদের ১১তম বাজেট। যতটুকু আমি বলেছি, তার থেকে অনেক বেশি কিছু রয়েছে বাজেটে। এই বাজেট জনকল্যাণমূলক। বাজেট যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, সেজন্য সবাই কাজ করবে।

বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট সেই লক্ষ্যমাত্রার পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে। এসডিজি বাস্তবায়ন ও সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা ও পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিহতদের স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

ব্যাংকের সুদ, আমানত নিয়ে গ্রাহকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে নানারকম মত রয়েছে। বিশেষ করে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা মেনে চলছে না তারা। তাই এ বিষয়ে আবারও ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে।

ব্যাংকঋণে সুদের হার নিয়ে ঋণগ্রহীতা, সাধারণ গ্রাহক, আমানতকারী, শিল্প উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও অসন্তোষ, ক্ষোভ আছে। বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং এক অর্থে জনদাবি হলেও কেন সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। তবু আশার কথা প্রধানমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্য এবং বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও এ নিয়ে তার সরকারের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি, যাতে সুদটা সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সুবিধাও দিয়েছি। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটা মানেনি। এবার বাজেটে নির্দেশনা দেওয়া আছেÑ এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে যাওয়া হবে। ব্যাংকগুলোকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। ঋণের সুদ যেন ডাবল ডিজিটে না হয়। তা হলে আমাদের বিনিয়োগ বাড়বে। বেশি আর চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদ হতে থাকলে মানুষ আর ব্যবসা করতে পারবে না। এদিকটায় আমরা বিশেষভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক আইন আমরা সংশোধন করব; সে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আর একটি বিষয়ে বিগত ১০-১১ বছর ধরেই লক্ষ করা গেছে, বাজেট ঘোষণার পর পর বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা, এনজিও বাজেট প্রতিক্রিয়া দিয়ে এর কঠোর সমালোচনা করে। এসব সমালোচনা কখনো কখনো অসত্য, কাল্পনিক তথ্য দিয়ে সরাসরি বাজেটের বিরোধিতা আবার কখনো কখনো বাজেট প্রত্যাখ্যান করে। নতুন অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সমালোচনাকে ভালো না লাগা পার্টির অসুস্থতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষ এই বাজেটে খুশি কি না, বাজেটে তাদের উপকার হচ্ছে কি না; সেটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড ও বাজেট নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড প্রশংসিত হলেও কারো কারো এটা ভালো লাগে না। আসলে ‘ভালো না লাগা পার্টি’র কিছুই ভালো লাগে না।

কিছু সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়ায় বলা হচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে সচ্ছল ও উচ্চ আয়ের মানুষকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে একজন সাংবাদিকের একটি প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা কী গবেষণা করেন আমি জানি না। এত সমালোচনা করেও আবার বলবে, আমরা কথা বলতে পারি না। আমার কথা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ খুশি কি না। তারা লাভবান হচ্ছে কি না, এটাই দেখার বিষয়। আজকে আমাদের ১১তম বাজেট। এটা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট। এর সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে। আর ভালো না লাগার বিষয়টা জানি না কী হবে, তবে দেশের জন্য তারা কী আনতে পারছেন, তা জানি না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, আমরা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সফল। আগে বিশ্বদরবারে ভিক্ষুকের জাত বলত, এখন আর কেউ এটা বলতে পারে না। এটাই বড় অর্জন। এমন অর্জন সত্ত্বেও সমালোচনা। আসলে ‘ভালো না লাগা পার্টি’র কিছুই ভালো লাগে না। যারা সমালোচনা করে, করে যাক। ভালো কিছু বললে গ্রহণ করব, মন্দ কিছু বললে ধর্তব্যে নেব না।

তিনি বলেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি উন্নীত করা সরকারের লক্ষ্য; এসডিজি বাস্তবায়ন ও সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই সর্ববৃহৎ বাজেট জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সরকারের বিগত দুই মেয়াদে ১০ বছরের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে তার মাধ্যমে জনগণের মাঝে আমাদের প্রতি আস্থা বেড়েছে। তার প্রতিফলন ঘটেছে গত ৩০ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে।

দেশের বেকার যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের আগাম পরিকল্পনা দরকার। এ লক্ষ্যমাত্রার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি যুবকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকি-প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও প্রণোদনা থাকবে। কৃষি ভর্তুকি, ঋণ ও কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রেও প্রণোদনা থাকবে।

আবার একটি কথা প্রধানমন্ত্রীসহ তার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে বলে আসছেন, গ্রাম হবে শহর। তথা শহরের আদলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসংবলিত পরিকল্পিত গ্রাম গড়ে তোলার কথা। এই বাজেটে, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়নে ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাজেটে আমার গ্রাম আমার শহর প্রসঙ্গে বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রাম যেন উন্নত হয়, সেখানকার মানুষ যেন শহরের মানুষের সুবিধা পায়, সেজন্য আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচির আলোকে পল্লী এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশজুড়ে ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার নতুন সড়ক এবং ৩০ হাজার ৫০০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। সেজন্য এ খাতে আগামী অর্থবছরে ৬৬ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

অবশ্য এবারের বাজেটে শিক্ষা সমাজের দাবিরও প্রতিফলন ঘটেছে। শিক্ষকদের দাবি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়টি। মন্ত্রণালয়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ থাকা এমপিওভুক্তির কাজ শুরু হয়েছে। অনুরূপ স্বাস্থ্য খাতেরও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে চিকিৎসা ও অন্যান্য সামাজিক সুবিধা নিশ্চিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৮টি মেডিকেল কলেজে নিউক্লিয়ার মেডিসিন ইনস্টিটিউট খোলা হবে। দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ চলছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আমরা অর্জন করব, সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শীর্ষক এবারের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এ বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে জনকল্যাণে ঘোষিত বাজেটে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি, উন্নযন, অগ্রযাত্রার রোডম্যাপ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে। তা হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। তাছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেও গত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা কালে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে সফলতা অর্জন করেছেন। এ কারণে আজ বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য মেয়ে প্রধানমন্ত্রীর যে অভিপ্রায় বা স্বপ্ন, তা পূর্ণ হবে। এ জন্য আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হবে, যে যার অবস্থান থেকে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close