নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্র্যালোচনা

ব্লাস্ট রোগ ও খাদ্য নিরাপত্তা

সারা দেশে এখন চলছে বোরো ধান রোপণের ধুম। কৃষক কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি তৈরি, চারা তোলা ও রোপণ কাজে ব্যস্ততম সময় অতিবাহিত করছেন। সম্প্রতি (৪ জানুয়ারি ২০১৯) ময়মনসিংহের ত্রিশালে কৃষিপ্রযুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে ধানিখোলা দক্ষিণ ভাটিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে বোরো ধান চাষিদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় উপস্থিত চাষিরা জানান, গত বছর যারা ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯ ও ব্রিধান ৫৮ চাষ করেছিলেন তাদের জমিতে এক ধরনের রোগের কারণে ধান চিটা হয়ে যায়। এতে ধানের ফলন হ্রাস পায় এবং ধান চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের জিজ্ঞাসা করলে রোগের নাম, কারণ ও রোগ দমনের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি। আমার ধারণা, দেশের অধিকাংশ কৃষকই ব্লাস্ট রোগ সম্পর্কে তেমন সচেতন নন।

ধানের ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত মারত্মক ক্ষতিকারক রোগ। আমাদের দেশে বোরো ও আমন মৌসুমে রোগটির আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। অনুকূল আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণে ধানের ফলন ৮০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় রোগটি দেখা দিতে পারে। এ রোগ সাধারণত ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ২৯, ব্রিধান ৫৮, লবণসহিষ্ণু জাত, সুগন্ধি ও হাইব্রিড জাতের ধানে ব্যাপকভাবে দেখা যায়। এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং শীষে আক্রমণ করে থাকে। সে অনুযায়ী রোগটি পাতাব্লাস্ট, গিঁটব্লাস্ট ও নেকব্লাস্ট নামে পরিচিত। পাতাব্লাস্ট ধানের চারা ও কুশি অবস্থায় আক্রমণ করে। প্রথমে পাতায় ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগগুলো বড় হয়ে মাঝখানটা ধূসর ও কিনারা বাদামি রং ধারণ করে। দাগগুলো একটু লম্বাটে এবং দেখতে অনেকটা চোখের মতো। একাধিক দাগ মিশে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো পাতাটি শুকিয়ে মারা যেতে পারে। পাতার চেয়ে গিঁট ও শীষ আক্রান্ত হলে ধানের বেশি ক্ষতি হয়। ধানগাছে থোড় হওয়ার আগে থেকেই গিঁটব্লাস্ট দেখা দেয়। গিঁট আক্রান্ত হলে কালো দাগ সৃষ্টি হয় ও পচে যায়। প্রবল বাতাসে আক্রান্ত স্থান ভেঙে যেতে পারে, তবে একদম আলাদা হয়ে যায় না। শিশির বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সময় ধানের ডিগ পাতা ও শীষের গোড়ার সংযোগস্থলে পানি জমে। ফলে ওই স্থানে ব্লাস্ট রোগের জীবাণু আক্রমণ করে কালচে বাদামি দাগ তৈরি করে। পরবর্তীতে আক্রান্ত শীষের গোড়া পচে যাওয়া গাছের খাবার শীষে যেতে পারে না, ফলে শীষ শুকিয়ে দানা চিটা হয়ে যায়। দেরিতে আক্রান্ত শীষ ভেঙে যেতে পারে। শীষের গোড়া ছাড়াও যেকোনো স্থানে এ রোগের জীবাণু আক্রমণ করতে পারে।

ব্লাস্ট রোগের জীবাণু প্রধানত বাতাসের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আর যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পায়, সেখানেই জীবাণু গাছের ওপর পড়ে রোগ সৃষ্টি করে। বীজের মাধ্যমে রোগটি ধানের চারায় ছড়াতে পারে, তবে তা পরিমাণে খুবই কম। প্রাথমিক অবস্থায় নেকব্লাস্ট রোগের আক্রমণ সহজে শনাক্ত করা যায় না। সাধারণভাবে যখন জমিতে নেকব্লাস্ট রোগের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়, তখন জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। সেসময় অনুমোদিত মাত্রায় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেও কার্যকরভাবে রোগটি দমন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য কৃষক ভাইদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। দিনের বেলায় গরম (২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠান্ডা (২০ থেকে ২২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড), শিশিরে ভেজা দীর্ঘ সকাল, অধিক আর্দ্রতা (৮৫ শতাংশ বা তার অধিক), মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, ঝড়ো আবহাওয়া এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এ রোগের আক্রমণের জন্য খুবই অনুকূল।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে জমিতে বিঘাপ্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ কেজি জৈব সার এবং সুষম মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি জাতের বেলায় বিঘাপ্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া, ১৩ কেজি টিএসপি/ডিএপি, ২২ কেজি পটাশ, ১৫ কেজি জিপসাম ও ১.৫ কেজি দস্তা সার এবং স্বল্পমেয়াদি জাতের বেলায় উল্লিখিত রাসায়নিক সারগুলো যথাক্রমে বিঘাপ্রতি ৩৫, ১২, ২০, ১৫ ও ১.৫ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়, তবে ডিএপি সার ব্যবহার করলে বিঘাপ্রতি ৫ কেজি ইউরিয়া কম লাগে। পটাশ দুই সমানভাগে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম ভাগ জমি তৈরির সময় এবং দ্বিতীয় ভাগ শেষ কিস্তি ইউয়িা সার উপরি প্রয়োগের সময়। সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত ধানের জমি থেকে সংগৃহীত বীজ ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া যেসব জমির ধান নেকব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি অথচ এলাকায় রোগের অনুকূল আবহাওয়া বিরাজমান, সেখানকার ধানের জমিতে রোগ হোক বা না হোক, শীষ বের হওয়ার আগমুহূর্তে প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৮ গ্রাম ট্রুুপার ৭৫ ডব্লিউপি/দিফা ৭৫ ডব্লিউপি অথবা ৬ গ্রাম ন্যাটিভো, ৭৫ ডব্লিউজি ছত্রাকনাশক ১০ লিটার পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে শেষ বিকেলে ৫ থেকে ৭ দিন অন্তর দুবার প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া ধানের জমিতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিলে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে ১ থেকে ২ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়। পাতাব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় একই নিয়মে নির্দিষ্ট মাত্রায় অনুমোদিত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে বোরো মৌসুমে ৪৭ লাখ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হচ্ছে। বোরো মৌসুমে শতকরা ৪১ ভাগ জমিতে ব্রিধান ২৮ এবং ২৪ ভাগ জমিতে ব্রিধান ২৯-এর চাষ হয়। অর্থাৎ বোরো ধানের প্রায় ৬৫ ভাগ জমি দখল করে আছে এই দুটি ম্যাগা ভ্যারাইটি। আজ থেকে ২৪ বছর আগে ১৯৯৪ সালে উদ্ভাবিত জাত দুটিতে নানা রকম রোগ আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলার সক্ষমতাও জাত দুটির হ্রাস পাচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের কোনো কোনো স্থানে জাত দুটিতে ব্যাপক ব্লাষ্ট রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অল্প কদিন আগে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পলাশতলী গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর ওই গ্রামের প্রায় ২০ একর ব্রিধান ২৮ জাতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের কারণে ধানের ফলন হ্রাস পায় এবং কৃষক আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হন। কোনো কোনো কৃষক খেত থেকে এক মুঠো ধানও বাড়িতে আনতে পারেননি এবং উৎপাদিত খড়ও গরুকে খাওয়াতে পারেননি। এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের মধ্যে রয়েছেন মো. নজরুল ইসলাম, মো. জালাল উদ্দিন ও মো. নসর আলী প্রমুখ। তাই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ জাত দুটির বিকল্প হিসেবে ব্রিধান ৮৮ ও ব্রিধান ৮৯ উদ্ভাবন করছে। ব্রিধান ৮৮, ব্রিধান ২৮-এর মতো স্বল্পমেয়াদি। এ জাতের জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। ব্রিধান ২৮-এর হেক্টরপ্রতি স্বাভাবিক ফলন যেখানে ৫-৬ টন, সেখানে ব্রিধান ৮৮-এর ফলন সাড়ে ৬ টন। অন্যদিকে ব্রিধান ৮৯-এর জীবনকাল ১৫৪ থেকে ১৫৮ দিন। ব্রিধান ২৯-এর স্বাভাবিক ফলন যেখানে সাড়ে সাত টন, সেখানে ব্রিধান ৮৯-এর ফলন হেক্টরপ্রতি ৮ টন। তাই ধান বিজ্ঞানীরা মনে করেন, নতুন জাত; ব্রিধান ৮৮ ও ব্রিধান ৮৯ কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করা গেলে দেশে ধানের উৎপাদন আগের চেয়ে বেশি হবে।

ব্লাষ্ট রোগের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ বছর ব্রিধান ২৮ ও ব্রিধান ২৯-এর পরিবর্তে ব্রিধান ৫৮ এবং বিভিন্ন বীজ কোম্পানির হাইব্রিড জাতের ধান আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষক। অপরদিকে প্রচলিত জাতের চেয়ে হাইব্রিড জাতের ফলন বেশি। চাল চিকন, খেতে সুস্বাদু। দেশে বোরো মৌসুমে চাষকৃত হাইব্রিড জাতের মধ্যে রয়েছে লালতীরের টিয়া, ময়না, বলাকা, দোয়েল, গোল্ড রাইচারও গোল্ডেন ওয়ান। এসিআইয়ের ছক্কা, বিএডিসির এসএল-৮ এইচ (সুপার হাইব্রিড), বায়ারের ধানিগোল্প, ত্যাজগোল্ড, সুপ্রিম সিডের হীরা-২ ও হীরা-১৯ এবং সিনজেন্টার ১২০৩ জাতগুলো চাষিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হাইব্রিড জাতগুলোও ব্লাস্ট রোগের প্রতি সংবেদনশীল। চীন হাইব্রিড ধানের চাষ বৃদ্ধি করে ধানের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।

লেখক : পরিচালক, কৃষিপ্রযুক্তি কেন্দ্র

ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close