সাধন সরকার

  ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

মতামত

দক্ষিণের স্বর্গ সেন্টমার্টিন

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ, অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও অপার সম্ভাবনার দ্বার সেন্টমার্টিন। নীল আকাশ আর সমুদ্রের নীলজল যেন চুপি চুপি ডাক দিয়ে যায়! সমুদ্রের নীল নির্মলতা সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ‘দক্ষিণের স্বর্গ’ সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে! দ্বীপটির অবস্থান মূলত বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটারের মতো। এ দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার। তবে জোয়ারের সময় আয়তন কিছুটা কমে যায়। প্রচুর নারিকেল গাছ থাকায় দ্বীপটি ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামেও পরিচিত। এ দ্বীপে আরো রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, স্তন্যপায়ী ও অমেরুদগুী প্রাণী। এ ছাড়া রয়েছে চুনাপাথর, বেলেপাথর, বালুচর ও ঝিনুক পাহাড়। দ্বীপটি সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির কাছিমের ডিম পাড়ার স্থান হিসেবেও খ্যাত। লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ দ্বীপটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সেন্টমার্টিনের প্রবাল প্রাচীর প্রাকৃতিক দেয়ালের মতো কাজ করে সুনামি, জলোচ্ছ্বাস ও সামুদ্রিক ঝড় থেকে উপকূলবাসীদের রক্ষা করে থাকে।

একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব; অন্যদিকে অতিরিক্ত মানুষের চাপে সেন্টমার্টিনের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সেন্টমার্টিনের কোনো কোনো স্থান ভাঙনের কবলে পড়েছে। লাল কাঁকড়ার বিচরণও এখন আগের থেকে কমে গেছে। দ্বীপটি কচ্ছপের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হলেও রাতের বেলা এখন আর কচ্ছপের দেখা মেলে না! মানুষের পদচারণায় কচ্ছপগুলো যেন ভয়ের জগতে হারিয়ে গেছে! মানুষের আনন্দের অভিশাপ কচ্ছপের ওপর তো আছেই তার ওপর আবার বেড়ে যাওয়া কুকুরের উপদ্রবেও কচ্ছপ নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার স্থানীয় অধিবাসীরা সেন্টমার্টিনের শামুক, ঝিনুক, প্রবাল সংগ্রহ করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছেন। আবার পর্যটকরা এগুলো মনের আনন্দে কিনছেন! পর্যটকদের ফেলে আসা প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য সামগ্রী দ্বীপের দূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ দ্বীপটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদের দায় সবচেয়ে বেশি। দ্বীপটির অধিবাসীরা একসময় মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন তারা শামুক-ঝিনুক-প্রবাল সংগ্রহ করাসহ পর্যটককেন্দ্রিক বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ছেন। অনেকে আবার দ্বীপের পাথর-নুড়ি কুড়ানোর পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন। সেন্টমার্টিনের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় ৯ হাজারে পৌঁছেছে। আয়তনের তুলনায় বাড়তে থাকা স্থানীয় এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস ও অতিরিক্ত পর্যটক আসার কারণে সেন্টমার্টিনে প্রতিদিনই বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। কোনো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্যরে দূষণে সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননে প্রভাব পড়ছে। পর্যটকবাহী জাহাজ থেকে নির্গত তেলের কারণে দ্বীপে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। জোয়ারের পানিতে দ্বীপের অধিকাংশ এলাকা নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে। পর্যটকদের বিভিন্ন পরিবেশবিরোধী কর্মকাগেুর ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে দ্বীপটি। দ্বীপের কেয়া বনের দীর্ঘ সারি এখন আর চোখে পড়ে না!

দ্বীপকে কেন্দ্র করে গড়ে বিভিন্ন ব্যবসাকেন্দ্রের ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই বহিরাগত। মুষ্টিমেয় লোকের হাতে এখানকার ‘পর্যটন অর্থনীতি’ জিম্মি হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা শুধু তাদের মুনাফা দেখছেন! দ্বীপের প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার দিকে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রকৃতি-পরিবেশবিরোধী কর্মকাগেু দ্বীপই যদি ভবিষ্যতে টিকে না থাকে; তা হলে এখানে কোনো ব্যবসাও থাকবে নাÑ এ কথা ব্যবসায়ীদের হয়তো জানা নেই! পর্যটন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দ্বীপটিতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বহু হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। সেন্টমার্টিন সৈকত এতটাই অরক্ষিত যে, পর্যটকরা কোনো ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে রক্ষা করার কোনো কর্তৃপক্ষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল! প্রকৃতির অপার দান সেন্টমার্টিনের মতো বিরল প্রবাল দ্বীপ রক্ষণাবেক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। জানা যায়, পাশর্^বর্তী অন্যান্য দেশের দ্বীপের সঙ্গে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সংযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে সেন্টমার্টিনের সার্বিক প্রকৃতি-পরিবেশ-সৌন্দর্য রক্ষা করতে না পারলে দ্বীপটির টিকে থাকার জন্য ঝুঁকি তৈরি হবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের অহংকার। এত স্বল্প আয়তনের কোনো স্থানে এমন নৈসর্গিক-মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, বিভিন্ন উদ্ভিদ-প্রাণী প্রজাতির সন্ধান পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। তবে দ্বীপটিকে রক্ষায় সরকারের উদ্যোগও থেমে নেই। আগামী ১ মার্চ থেকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সরকারি এক উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপ ও গলাচিপা পয়েন্টে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অনেক দেশই এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলছে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ইতোমধ্যে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি হারিয়ে গেছে। দ্বীপরাষ্ট্রের জীববৈচিত্র্য আজ বেশি হুমকির সম্মুখীন! দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে নানাবিধ দুর্যোগ। তাই পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের ছোট ছোট দ্বীপগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সেন্টমার্টিনের নলকূপে লবণপানি পাওয়া যাচ্ছে। বর্ষায় সেন্টমার্টিনের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও দক্ষিণাংশের ভাঙন দেখা দেয়। বলা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না! সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় সরকার, পর্যটক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ কারও কোনো অবহেলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে এ দ্বীপটিকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close