ইফতেখার হোসাইন
নিবন্ধ
উপকূলের অক্সফোর্ড নোবিপ্রবি
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান এগিয়ে চলছে, এর মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) অন্যতম। উপকূলের অক্সফোর্ডখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টি উন্নত অবকাঠামো এবং একাডেমিক ও গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি নাম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা নোয়াখালীর প্রকৃতি ও জনপদে বিশ্বমানের শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গেই অগ্রসর হচ্ছে নোবিপ্রবি। মূলত জাতীয় পর্যায়ে নতুন জ্ঞান তৈরি এবং গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির জন্যই ২০০১ সালে নোয়াখালীতে একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধন্ত গৃহীত হয়। তার আলোকে ২০০১-এর ১৫ জুলাই সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা আইন জারি হয়। ফলে ১৫ জুলাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (বিশ্ববিদ্যালয় দিবস)। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষালাভের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। দেশের বাজারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়েছে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বের বাজারেও দক্ষ জনবল সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সোনালি দিন হলো নোবিপ্রবির বর্তমান সময়ের অর্জনকে আরো বেগবান, সফলতার পথে বাধা দূরীকরণ ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা পুনর্নির্ধারণ করে সামনে চলার প্রত্যয় গ্রহণের দিন।
অর্জন : ২০১৫ সালের ২ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন প্রফেসর ড. এম অহিদুজ্জামান। যোগদানের পর থেকে নোবিপ্রবিকে একটি উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নানামুখী কর্মকা- পরিচালনা করছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের উন্নত পাঠদান ও বিশ্বমানের শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে উচ্চতর ডিগ্রি পিএইচডি, এমফিল, এমএস ও পোস্টধারী শিক্ষকদের নিয়োগ দেন। বিগত ৩ বছরে (২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮) নতুন ১৪৬ জন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। এর মধ্যে ৩৫ জনই আছেন পিএইচডিসহ উচ্চতর ডিগ্রিধারী। তিন বছরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো বেশি শিক্ষার্থীকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে নতুন ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট খোলা হয়। শিক্ষার্থীদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে সচেতন করতে ‘বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন’ বিভাগ খোলা হয়। যুগোপযোগী ক্যারিকুলামে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নামক কোর্স এখানকার সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ল্যাবরেটরিগুলোর আধুনিকায়ন করার ফলে এখানকার শিক্ষকরা গত তিন বছরে ২০৮টি মৌলিক গবেষণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশে গবেষণা ক্ষেত্রে নতুন মাইলফলক হিসেবে পমেটো উদ্ভাবন, ক্যালসিয়ামযুক্ত ও বিষমুক্ত ‘এনএসটিইউ ঢেঁড়স-১’-সহ ডায়েবেটিকমুক্ত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন গবেষক। প্রাণিজগতে চারটি নতুন অমেরুদ-ী প্রাণী ‘নেপথাইস বাংলাদেশ’ বিক্টোরিওপি ব্রুনেইসিস, নিউমোনিয়া নোবিপ্রবি এবং অ্যাররেনারুস স্মিটি’ আবিষ্কারসহ দেশীয় ছোট মাছ বউরানি ও গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন, রেণুপোনা লালন-পালনের সফল প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিজ্ঞানীরা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষা সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছে, যাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ওইসব দেশের প্রায়োগিক জ্ঞান ও গবেষণায় সঙ্গী হতে পারে। এ সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১০০ শিক্ষক ও কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান এবং গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে নোবিপ্রবি গ্রন্থাগারে প্রায় ১৪ হাজার বই, ৪৪৬ জার্নাল, ৩৬ হাজার ইলেকট্রনিক বই, ৪ লাখ ৫০ হাজার ইলেকট্রনিক জার্নাল সন্নিবেশ করা হয়েছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়কে বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাবগুলো কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ। এ ছাড়া পুরো ক্যাম্পাসকে আনা হয়েছে হাইস্পিড ইন্টারনেট-বিডিরেন ওয়াইফাইয়ের আওতায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্ভাব্য প্রধান অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে সাতটি বিভাগে মাস্টার্স চালুকরণ, শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি বাস ক্রয়, আইসিটি ল্যাব ও বিজ্ঞান গবেষণাগারসমূহে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারকম সুবিধা চালুকরণ। এ ছাড়া আরো রয়েছে ১০০ কেভিএ বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন স্থাপন, তিনতলা ভিতে মেডিকেল সেন্টার, ১০-তলা ভিতে হাউস টিউটর ও প্রভোস্ট কোয়াটার্স, তিনতলা ভিতে কেন্দ্রীয় মসজিদ, উপাসনালয়, ১০-তলা ভিতে স্টাফ কোয়ার্টার্স নির্মাণকাজ করা। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেশের সর্ববৃহৎ ৪০ হাজার ৩৩৫ বর্গমিটার আয়তনের সুবিশাল একাডেমিক কাম ল্যাব ভবনের পাইলিং কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক উকিল হলের (ছাত্রী) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষক-কর্মকর্তা কোয়ার্টার্স (১০-তলা ভিতে ১০-তলা) ভবনের পাইল ক্যাপ, লাইব্রেরি ভবন (প্রথম-চতুর্থতলা), অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস ভবনের (তৃতীয়-পঞ্চমতলা), একাডেমিক ভবন-২ (পঞ্চম-দশমতলা) এবং ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনকাজ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
পরিকল্পনা : সরকারের ভিশন ২০৪১ সালে একটি উন্নত আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দেশের টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি-সাস্টেইনএবল ব্লু ইকোনমি প্রসারের লক্ষ্যে ‘নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট স্থাপন’ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। একাডেমিক গবেষণাকে ত্বরান্বিত করতে নোবিপ্রবিতে ডেল্টা প্ল্যান গঠন, মহাকাশ বিষয়ে গবেষণা, এনভায়রনমেন্ট অনুযায়ী ইকোলজি বিষয়ে পঠন-পাঠন ও ব্যবস্থাপনার কাজ করা হবে। এ ছাড়া রোবোট্রিকস ও মেকাট্রোনিকসের মতো যুগোপযোগী বিভাগের দ্বার উন্মোচন করা হলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কর্মপরিধি। গবেষণার মান বৃদ্ধির জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে গ্রিন হাউস গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। যেখানে সিনিয়র/জুনিয়র রিসার্চসাররা যৌথ গবেষণা করবেন। সেখানে পঞ্চমতলা ভিতে ল্যাবরেটরি ভবন তৈরি করা হবে। নিকট ভবিষ্যতে মেরিন স্টেশন নির্মাণের জন্য ৩০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল পরিকল্পনার অন্যতম। সমুদ্র তীরে সেখানে জেটির অবকাঠামো তৈরি করা হবে, হ্যাচারি এবং মিনি পন্ড কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় গভীর সমুদ্রগামী গবেষণা জাহাজ এবং একটি উপকূলীয় গবেষণা জাহাজ ক্রয় করবে। এ ছাড়া দোতলা স্পেইস রিসার্চ সেন্টার নির্মাণ, ক্যাম্পাসে একটি হেলিপ্যাড নির্মাণের পরিকল্পনাও করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা নিরসনে আগামীতে দেশের সর্ববৃহৎ ২০-তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে। আর পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে নির্মাণ করা হবে ২০-তলা ভিতে আলাদা ছাত্র ও ছাত্রীহল। বিদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য ১০-তলা ভিতে আন্তর্জাতিক হল নির্মাণ করা হবে। ভৌত ও একাডেমিক সুবিধা বৃদ্ধীকরণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় আগামীতে তিনতলা ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ, ক্যাম্পাসে চাইল্ড কেয়ার সেন্টার ও টিএসসি ভবন তৈরি, আনসারদের জন্য ব্যারাক নির্মাণ, আরো দুটি সাব-স্টেশন বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে সুবর্ণচর এলাকায় ২০-তলা নতুন ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হবে।
চ্যালেঞ্জগুলো : বিশ্ববিদ্যালয়টির ভৌগোলিক অবস্থান উপকূলে ও নোয়াখালী জেলা শহর থেকে দূরবর্তী হওয়ায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতা রয়েছে এখানে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম সড়ক পথ, রেলপথ সুবিধা অপ্রতুল আর বিমান যোগাযোগ নেই। ফলে অভিজ্ঞ যোগ্যতাসম্পন্ন উচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের এখানে নিয়োগ দেওয়া, একাডেমিক সভা, সেমিনারে তাদের নিয়ে আসা দুরূহ হয়ে পড়ে। বৃহত্তর নোয়াখালীর শিক্ষার্থীরা ছাড়া অন্য জেলার মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে দোদুল্যমান থাকে। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, যতটুকু বরাদ্দ পাওয়া যায়, তার সুষম বণ্টন হয় না। গবেষণার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ছাড়া চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ সুবিধার অপর্যাপ্ততা। ১০০ একরের ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনে দিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু তদানুযায়ী একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও হলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তার ওপর রয়েছে স্থান স্বল্পতা, তাই নতুন জায়গা অধীগ্রহণ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিটিসিএলের টেলিফোন/ইন্টারনেটের নিরবচ্ছিন্ন সেবার অসুবিধা দূরীকরণ সময়ের দাবি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, পানির সমস্যা এবং যানবাহনের অপ্রতুলতা সমাধান আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। যাবতীয় অবকাঠামো উন্নয়নে পেশাদার ও প্রতিশ্রুতিশীল ঠিকাদার এখানে পাওয়া যায় না।
লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
"