ফনিন্দ্র সরকার

  ১৬ জুলাই, ২০১৮

বিশ্লেষণ

রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও নেতৃত্ব

বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা খুব কঠিন। দীর্ঘ রাজনৈতিকচর্চার মধ্য দিয়ে একটি দেশের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সত্যকে সামনে রেখে আমাদের রাজনীতিকরা তাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি সমন্বিত রাখবেনÑএটা দেশবাসীর প্রত্যাশা। সময়ের প্রয়োজনে কোনো দেশের রাজনীতির গতিপথ বদলে যায়। রাজনীতির পথ বদলে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল আমাদের বাংলাদেশ। যার নেতৃত্বে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, তিনি ইতিহাসের মহানায়ক সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংগত কারণেই তিনি জাতির পিতা। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ১৯৭৫ সালে দেশি-বিদেশি ফ্যাসিস্ট শক্তি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে অবস্থানের কারণে তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। রাজনৈতিক এই জঘন্য ঘটনার পর স্বার্বভৌম বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে ওঠে সংকটাপন্ন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সংকটের বোঝা বহন করে যাচ্ছে এখনো। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে গিয়ে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েও গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণœ রেখে চলেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই এ দেশের রাজনীতিকে ডমিনেট করছে। রাজীতিতে এ দুটো দলের বাইরে ছোট ছোট যে দলগুলো আছে, তাদের স্বতন্ত্র কোনো অবস্থান নেই। বিভক্তির আলোকে অন্যরা এ দুটো দলের সঙ্গে জোটভুক্ত। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি কিছুটা স্বতন্ত্র অবস্থানে থাকলেও সুবিধাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত।

প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি বিষয় আলোকপাত করতে বাধ্য হচ্ছি, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা এ দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী কার্যক্রম শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর থেকে রাজনৈতিক নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটে এবং তিনি বাংলাদেশের স্ব-ঘোষিত নায়কে পরিণত হন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধী-৭১-এর গণহত্যাকারীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পুরস্কারস্বরূপ বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। কার্যত রাজনীতির সংকট শুরু সেখান থেকেই। জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়ে দেশের রাজনীতিকে পচা নর্দমায় পরিণত করেন, যা থেকে এখনো আমরা বের হতে পারিনি। আর তাই রাজনীতি চলে গেছে দুর্বৃত্তদের হাতে। প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনীতিক এখন হাতে গোনা কিছু রয়েছে মাত্র। সে জন্য সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এর গতি-প্রকৃতিও পরিবর্তন হচ্ছে তীব্র গতিতে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য বাম-ডান যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে, এর কোনোটিই প্রকৃত রাজনীতিকদের নিযন্ত্রণে নেই। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার ক্ষমতায়, এটাকে মহাজোট সরকার হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সরকারের যেসব রাজনৈতিক দল অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালনা করছে, এদের মধ্যে নানা মত ও পথের শাখা-প্রশাখার যোগসূত্র রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে রক্ষণশীল ইসলামপন্থিদের প্রভাব বেড়েছে। অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার পরও এর প্রভাব বৃদ্ধি একটা অশনিসংকেত বটে। তথাকথিত উদার এবং গণতান্ত্রিক চেতনার কথা বলে আমরা যতই গলা ফাটাই না কেন, কট্টরপন্থি কিংবা রক্ষণশীল ইসলামী মৌলবাদের কাছে আমরা যেন আত্মসমর্পণ করেই যাচ্ছি। এই নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের কারণে রাজনীতি তার সঠিক পথ হারিয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে আমলা, শিল্পী, ক্রীড়াবিদরা (যাদের নিম্নতম রাজনৈতিক চর্চা নেই) রাজনীতিতে নেতার আসনে বসে গেছেন। তা ছাড়া উঠতি ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে রাজনীতিকে অর্থ ও পেশিশক্তির আদলে ভিন্নমাত্রায় অভিসিক্ত করেছেন। এতে গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো মূলত শক্তির ওপরই নির্ভরশীল। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। এ শক্তির অপকর্মগুলো দয়ামুক্তি পাওয়ারও সুযোগ গ্রহণ করে। সরকারি নিপীড়ক যন্ত্র ব্যবসায়ী, আমলা এবং ইসলামী মৌলবাদচক্র যার যার অবস্থান থেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এ চক্রের খপ্পরে পড়ে রাজনীতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অসুস্থ রাজনীতির প্রভাবে সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান উন্নয়ন আমাদের অনুরণিত করলেও ভেতরে ভেতরে প্রচ- শঙ্কা বিরাজ করছে। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে সরকারের ভেতরে একটি চক্র অসহিষ্ণু পরিস্থিতি তৈরির জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অতি উৎসাহীরা মাত্রাহীন বেপরোয়া আচরণ করছে। উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংশ্লিষ্টদের ওপর পুলিশি নিপীড়ন ও ছাত্রলীগের নগ্ন হামলা সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদেরÑএটা যৌক্তিক কী অযৌক্তিক আমি সে বিতর্কে যেতে চাই না। এটার সুষ্ঠু ও দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে একজন মানবিক গুণাবলির অধিকারী। তিনি দেশ ও জাতির জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এটা সবাই জানেন। তিনি যে শেষ ভরসার জায়গা, এটা বুঝেই দেশের সব শেণি-পেশার মানুষ তার কাছে একটু বেশিই দাবি করেন। তিনি সাধ্যমতো সব সমস্যারও সমাধান দেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। শেখ হাসিনার সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কোনো কোনো মহল অতিমাত্রায় বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক হয়ে গেছেন। কারণে-অকারণে অতিমাত্রায় শেখ হাসিনার গুণকীর্তনে ব্যস্ত থাকেন কেউ কেউ। বঙ্গবন্ধুর সময় খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করতেন সবচেয়ে বেশি। যতদূর মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে মোশতাক উচ্চস্বরে কেঁদে ছিলেন। মোশতাক কবরের ভেতর নেমে গিয়ে কেঁদেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে সান্ত¦না দিয়েছিলেন। অবস্থাটা এ রকম ছিল যেন মোশতাকের জন্মধাত্রী মা মারা গেছেন। পরে মোশতাকের আসল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতির আকাশে যে কালো মেঘ জমা হয়, সেই মেঘ থেকে কতবার ঝড়-বাদল হয়েছে, তা সবারই জানা। রাজনীতির প্রকৃতির রংও বদলে গেছে সীমাহীনভাবে।

আজ রাজনীতির আবহাওয়ার যে পরিবর্তনটা আমরা লক্ষ করছি, তা ক্ষমতাসীন দলের জন্যও সুখবর নয়। কেননা এদের প্রতিপক্ষ কোনো রাজনৈতিক দল বলতে কিছু নেই। কাগজে-কলমে বিএনপি প্রতিপক্ষ হলেও তাদের সাংগঠনিক শক্তি খুবই দুর্বল। তা ছাড়া বিপুল জনসমর্থিত বলে চিহ্নিত বিএনপি জনগণের কল্যাণের কোনো রাজনীতি করছে না। তারা কেবল ব্যস্ত রয়েছে নেত্রীকে নিয়ে। তাদের নেত্রীর বাড়ি গেল, ঘর গেল, জেল হলোÑএসবই তাদের আন্দোলনের মূল অনুষঙ্গ। এই অনুষঙ্গভিত্তিক রাজনীতি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। কার্যত বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গায় সঙ্গায়িত নয়। ক্ষমতার মসনদে বসে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত এই দলটিতে সুবিধাবাদ শ্রেণির আধিক্য রয়েছে। অসৎ, ফ্যাসিবাদী ও জঙ্গি মানসিকতায় বিশ্বাসীরাই এ দলটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গণতান্ত্রিক কোনো চর্চা এ দলে নেই।

এদিকে বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের ভেতর সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চাও নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, তা টেকসই না হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের যে বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন, সে বার্তা বহন করে কেউ পরিবর্তন হচ্ছেন না। জেলাপর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে অনুপ্রবেশকারী কিছু নেতা সাধারণ মানুষের ওপর যে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন, তা রীতিমতো ভয়ংকর। যারা এ অপকর্ম করছেন, তারা আওয়ামী লীগের নয়। জামায়াত-বিএনপি ঘরানার লোকরা আওয়ামী লীগে অনুপ্রেবেশ করে এসব করছেন। তাদের পেছনে ইন্ধন জোগাচ্ছেন পুলিশ প্রশাসনের লোকরা। অতএব, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে। প্রকৃতই যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করে তারা কখনো বেপরোয়া হতে পারেন, আমি এটা বিশ্বাস করি না। রাজনীতির গতিপথটাকে এরাই কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছেন। বিএনপি-জামায়াত অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে। নানা কৌশলে তাদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা তারা করবেই। এদিকে সতর্ক হতে হবে আওয়ামী লীগের নেতাদের।

দেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে সরকারের ভেতরে যে ছায়াশক্তি কাজ করছে, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিতে পারলে বাঙালি জাতির জীবনে আবার অন্ধকার নেমে আসবে। তাই সময় থাকতে সতর্ক হতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক সেজে শেখ হাসিনার চারপাশে ঘুর ঘুর করেন, তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। আমার জানা মতে, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এমন অনেক ব্যক্তি নৌকার প্রতীক নিয়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন করে জয়ী হয়ে নেতা হয়েছেন। স্থানীয় এমপি সাহেব ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই টাকার বিনিময়ে সে সুযোগ করে দিয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক চেতনার রাজনীতির ধরনও পাল্টে গেছে। রাজনীতির এমন সংস্কৃতি নেতৃত্বের ভাবমূর্তিকেও ক্ষুণœ করছে। রাজনীতির সঠিক চিন্তার জায়গাটাকে মজবুত করতে হবে। ক্ষমতায় যে-ই অধিষ্ঠিত হোন না কেন, বাঙালির মূল চেতনাটা যেন সমুন্নত থাকে। তবেই রাজনীতির গতিপথ স্রোতের অনুকূলে থাকবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist