সাধন সরকার

  ১২ এপ্রিল, ২০১৮

মতামত

কোটা পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে

দেশের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। সরকারি হিসেবে দেশে এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কোটা ব্যবস্থার কারণে সাধারণ প্রার্থীদের চাকরি নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। দেশের সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত চাকরির শতকরা ৫৬ ভাগই দখল হয়ে যায় কোটাধারীদের জন্য। আর বাকি মাত্র ৪৪ ভাগ সাধারণের জন্য বরাদ্দ। বর্তমানে ‘বিসিএস’সহ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার হালচাল হলোÑ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। সংবিধানের ১৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ ২৯(১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ীÑ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’

১৯৭১ সালে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন, বৈষম্যহীন এক স্বপ্নের সোনার বাংলা উপহার দেওয়া। মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। আরো সুযোগ- সুবিধা দিলেও তাতে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করি না। কিন্তু মোধাবীদের পাশ কাটিয়ে কোটায় কম মেধাবী নিয়োগ পেয়ে গেলে দেশ ও দেশের মানুষ উত্তম সেবা থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, কতকাল ধরে চলবে এ কোটা ব্যবস্থা? ১৯৭২ এ দেশে সর্বপ্রথম কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল অনগ্রসর গোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করা। বর্তমানে সব মিলিয়ে দেশে ২৫৮ ধরনের কোটা বিদ্যমান রয়েছে। সরকারি প্রথম, দ্বিতীয় শ্রেণিসহ অধিকাংশ চাকরির নিয়োগের শেষপর্যায়ে এসে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার বেশির ভাগ পদ উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবে খালি পড়ে থাকে। এ খালি পদগুলোয় সাধারণ প্রার্থীকেও নিয়োগ দেওয়া হয় না। এতে রাষ্ট্র প্রয়োজনমাফিক মাঠপর্যায়ে জনসাধারণকে পরিপূর্ণ সেবা দিতে পারে না। যেখানে কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া যাবে, সেখানে সাধারণ প্রার্থী থেকে যোগ্য লোক নেওয়া কি উচিত নয়? মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আবার যুক্ত করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনির কোটা। বংশ পরম্পরায় এ ব্যবস্থা রাখার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে করি না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য শুধু এককভাবে বিভিন্ন বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা যেমন বিসিএস (৩২তম, ২৩তম বিশেষ বিসিএস), ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে (বিভিন্ন মন্ত্রণালয়) পরীক্ষা হয়ে থাকে। এর ফলে সাধারণ ছেলেমেয়েরা আজ আবেদন করার সুযোগটুকুও হারাতে বসেছে। একবার নয়, চাকরির নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা নিচ্ছেন কোটাধারীরা।

এই অযৌক্তিক কোটাব্যবস্থা সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ-তরুণীদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। যেখানে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে পড়ালেখা শেষ করে বসে আসে। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে বৈকি কমছে না। এই মেধাবীদের বঞ্চিত করে নাতি-নাতনিদেরর কোটা সুবিধা দেওয়া কতটা যৌক্তিক? একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কখনো চাইবেন না যে, যোগ্য মেধাবী না এসে একজন কোটাধারী অধিকতর কম মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে দেশ সেবায় আসুক! এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। দেশে দারিদ্র্যের হার ২৩ শতাংশের কাছাকাছি। অতিদারিদ্র্যের হারও কমে গেছে। এ ছাড়া বর্তমানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৬৬ শতাংশের ওপরে। যারা প্রকৃত অনগ্রসর তারা কি কোটা সুবিধা পাচ্ছে? অনগ্রসরের তকমা লাগিয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে আর কতকাল মেধাবীদের বঞ্চিত করা হবে?

এবার আসা যাক জেলা ও নারী কোটায়। নারীরা ইতোমধ্যে অনেকটা এগিয়ে আসা শুরু করেছে। এখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখেও শোনা যায় নারীরা আর পিছিয়ে নেই। এখন তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদেরও ছাপিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কত দিন ধরে চলবে এই নারী কোটা? নারী কোটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। জেলা কোটাও সংস্কার করা জরুরি। কিসের ভিত্তিতে জেলা অনগ্রসর বিবেচনা করা হচ্ছে? ধরে নিলাম, অনগ্রসর জেলা রয়েছে। তাহলে সরকার তা দূর করার ব্যবস্থা কতটুকু নিচ্ছে? ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোটাও কমানো উচিত। কেননা উপযুক্ত প্রার্থীর অভাবে বিভিন্ন নিয়োগের বেলায় দেখা যায়, এ কোটায় পদ খালি পড়ে থাকে। তাই এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোটা ২ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত। আর প্রতিবন্ধী কোটা যেটা আছে অর্থাৎ ১ শতাংশ, এটা যৌক্তিক বলে মনে হয়।

সর্বোচ্চ মেধাবীদের সেবা থেকে দেশ ও দেশের মানুষ বঞ্চিত হতে পারে না। মেধাবীরা কি তারচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন একজনকে তার ওপরে দেখতে চাইবে? এ দেশে মেধার মূল্যায়ন না করার কারণে দেশের মেধা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ন্যায়পরায়ণতা ও বাস্তবতার স্বার্থে এই কোটা ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। কোটার কারণে সমাজে চরম বৈষম্য ও অবিচার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ‘দিনবদলের সনদ’ নামক নির্বাচনী কর্মসূচিতে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে গুরুত্ব দেওয়ার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করেছিল। ২০১২ সালের সরকারের শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে তারা এ অঙ্গীকার পুনরায় ব্যক্ত করেছে। এগুলো কি তাহলে শুধু কথার কথা! কোটার কারণে অধিকতর যোগ্য প্রার্থীরা দিনের পর দিন বঞ্চিত হচ্ছেন। সময়ের দাবি, সর্বক্ষেত্রে যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হোক। লাখ লাখ মেধাবী বেকার তরুণ-তরুণীর পাশ কাটিয়ে তুলনামূলক কম মেধাবীদের দিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গঠন সম্ভব নয় বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist